পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৫২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

করিতেছেন, রুটি প্রস্তুত হইল, সকল খাইও না, অর্ধেক খাও, অর্ধেক রাখিয়া দাও, আবার ক্ষুধা পাইলে কোথায় পাইবে? ঐ শুন, ক্রন্দনধ্বনি শ্রুত হইল। একটি বালিকার হস্ত হইতে বন্য বিড়াল রুটি কাড়িয়া লইয়া গেল, রাজকন্যা ক্ষুধায় চীৎকার করিয়া ক্রন্দন করিতেছে!

 রাজপুত। প্রতাপের জয়গীত গাও, তিনি পঞ্চবিংশ বৎসর মোঘলদিগের সহিত যুদ্ধ করিয়াছেন, পর্বতশিখরে বাস করিয়াছেন। পর্বত উপত্যকায় যুদ্ধ করিয়াছেন, পর্বতকন্দরে পরিবারকে পালন করিয়াছেন; তথাপি ইহজন্মে আকবরের অধীনতা স্বীকার করেন নাই। পর্বতে পর্বতে এই গীত প্রতিধ্বনিত হইতে থাকুক, সমগ্র রাজস্থানে এই গীত শব্দিত হইতে থাকুক, হিমালয় হইতে প্রতিহত হইয়া সাগরবারি পর্যন্ত সঞ্চরণ করুক, হিমালয় অতিক্রম করিয়া সমস্ত জগতে ব্যাপ্ত হউক, আর যদি স্বর্গে সাহস ও স্বদেশানুরাগের গৌরব থাকে, এই গীত আকাশপথে উত্থিত হইয়া স্বর্গের দ্বারে আঘাত করিয়া মানবের যশঃকীর্তি বিস্তার করুক!”

 চারণের ভীষণ গর্জন শুনিয়া সকলেই স্তম্ভিত হইয়া রহিল। ক্ষণপরে সকলেই চাহিয়া দেখিল, চারণ নাই। তাঁহার চিহ্নমাত্রও নাই, কেবল আকাশে মেঘরাশি ভীষণ গর্জন করিয়া যেন তাঁহার ভয়াবহ গীত বার বার ধ্বনিত করিতে লাগিল।

 রাজপুতেরা স্বদেশের পূর্বগৌরব স্মরণ করিতে করিতে উৎসাহে হুঙ্কার করিয়া উঠিল, যোদ্ধাদিগের চক্ষু বীরাশ্রুতে ছল ছল করিতে লাগিল। অনেকক্ষণ পর তাহারা উঠিয়া আপন শিবিরে প্রস্থান করিল। নরেন্দ্র তাহাদের সহিত প্রস্থান করিলেন না, তিনি হস্তে গণ্ডস্থল স্থাপন করিয়া সেই মেঘাচ্ছন্ন রজনীতে ভীষণ চিতোর দুর্গের তলে বসিয়া কি চিন্তা করিতে লাগিলেন। মেঘ ক্রমে গাঢ়তর হইয়া আসিতেছে, নরেন্দ্র প্রস্থান করিলেন না। আকাশের প্রান্ত হইতে প্রান্ত পর্যন্ত উজ্জ্বল বিদ্যুল্লতা জগৎ ও গগনমার্গ চমকিত করিতে লাগিল, রহিয়া রহিয়া মেঘ ভীষণ গর্জনে পৃথিবী কম্পিত করিতে লাগিল, রহিয়া রহিয়া নৈশ বায়ু ভীষণ উচ্ছ্বাসে বহিতে লাগিল, নরেন্দ্র প্রস্থান করিলেন না।

 নরেন্দ্র ভাবিতে লাগিলেন, স্বদেশেও মহাবল-পরাক্রান্ত রাজারা আছেন, তবে সুদূর বঙ্গদেশের এ দুর্দশা কেন? যুদ্ধই রাজপুতদের ব্যবসা; বালক, বৃদ্ধ সকলেই যুদ্ধশিক্ষা করে, তাহারা ধন দিয়াছে, ঐশ্বর্য দিয়াছে, প্রাণ দিয়াছে, তথাপি স্বাধীনতা বিসর্জন দেয় নাই। তাহাদের গ্রাম দগ্ধ হইয়াছে, নগর লুণ্ঠিত হইয়াছে, দুর্গ শত্রুহস্তে পতিত হইয়াছে, তথাপি তাহারা গৌরব বিসর্জন দেয় নাই। সে গৌরবগীত আজিও আরাবল্লীর কন্দরে ও উপত্যকায় প্রতিধ্বনিত হইয়াছে। আর বঙ্গদেশ। বেগপ্রবাহিনী গঙ্গানদী তাহার গৌরবগীত গায় না, ব্রহ্মপুত্র স্বাধীনতার গীত গায় না, রাজা-প্রজা সকলেই বড়

৫২