পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

হও, আমি সেই শিশুদের পিতৃস্বরূপ হইব, যোধপুরের রাজ্ঞী স্বয়ং তাহাদের মাতা হইবেন। এখনও রাজ্ঞীকে আমাদের আগমন সংবাদ দেওয়া হয় নাই, আমাদের দূত যাইতেছে। যাও, তুমি স্বয়ং দূতের সঙ্গে যাইয়া রাজ্ঞীর নিকট গজপতির আবেদন জানাও এবং তাহার শিশুদেৱ জন্য দুটি কথাও বলিও।”

 রাজার আজ্ঞানুসারে নরেন্দ্র কয়েকজন রাজপুত দূতের সহিত যোধপুর দুর্গে গমন করিলেন। যোধপুর দুর্গ যাঁহারা একবার দেখিয়াছেন, তাঁহারা কখনও বিস্মরণ হইতে পারিবেন না। চতুর্দিকে কেবল বালুকারাশি ও মরুভূমি, তাহার মধ্যে একটি উন্নত পর্বত সেই পর্বতের শিখরের উপর যোধপুব দুর্গ যেন যোদ্ধার কিরীটের ন্যায় শোভা পাইতেছে। পর্বততলে নগর বিস্তৃত রহিয়াছে এবং নগরের ভিতর দুইটি সুন্দর হ্রদ; পূর্বদিকে রানী তলাও ও দক্ষিণ দিকে গোলাপ সাগর। নগরবাসিনী শত শত কামিনী হ্রদ হইতে জল লইতে আসিতেছ হ্রদের পার্শ্বস্থ সুন্দর উদ্যানে শত শত দাড়িম্ববৃক্ষ ফল ধারণ করিয়াছে ও নাগরিকগণ স্বচ্ছন্দচিত্তে সেই উদ্যানে বিচরণ করিতেছে। নগর নীচে রাখিয়া একদণ্ড ধরিয়া পর্বত আরোহণ করিয়া নরেন্দ্র প্রাসাদে পৌঁছিলেন। রাজ্ঞীর আদেশে দূতগণ ও নরেন্দ্র প্রাসাদে প্রবেশ করিলেন।

 শ্বেতপ্রস্তর-নির্মিত রাজসিংহাসনে মহারাজ্ঞী বসিয়া আছেন, চারদিকে সহচরী বেষ্টন করিয়া রহিয়াছে ও চামর ঢুলাইতেছে। রাজ্ঞীর বদনমণ্ডল অবগুণ্ঠনে কিঞ্চিৎ আবৃত হইয়াছে, তথাপি সে নয়নের অগ্নিবৎ উজ্জ্বলতা সম্যক্ লুক্কায়িত হয় নাই। গরীয়সী বামা যথার্থই রাজমহিষীর ন্যায় সিংহাসনে বসিয়া আছেন, নিবিড় কৃষ্ণকেশে উজ্জ্বল রত্নরাজি ধক্‌-ধক্ করিতেছে।

 দূত প্রণত হইয়া ধীরে ধীরে সভায় সকল সংবাদ জানাইলেন। মহারাজ্ঞী ক্ষণেক নিস্তব্ধ ও নিস্পন্দ হইয়া রহিলেন, বজ্রপাত ও ঝটিকার পূর্বে আকাশমণ্ডল যেরূপ নিস্পন্দ থাকে সেইরূপ নিস্পন্দ হইয়া রহিলেন। সহসা অবগুণ্ঠন ত্যাগ করিয়া আরক্তনয়নে দূতের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন, “কাপুরুষ! সেই সিপ্রানদীতে আপনার অকিঞ্চিৎকর শোণিত বিসর্জন করিতে পার নাই? আমার সম্মুখ হইতে দূর হও, আর তোমার প্রভু সেই কাপুরুষকে বলিও, তিনি যুদ্ধক্ষেত্র হইতে পলায়ন করিয়া কলঙ্করাশিতে কলঙ্কিত হইয়াছেন, তিনি আর এ পবিত্র দুর্গে প্রবেশ করিতে পারিবেন না।” এই কথা বলিতে বলিতে রাজ্ঞী মূর্ছিত হইয়া পড়িলেন।

 রাজ্ঞীর সহচরীগণ অনেক যত্নে রাজ্ঞীর চৈতন্যসাধন করিল। তখন রাজ্ঞী ক্রোধে প্রায় জ্ঞানশূন্যা হইয়া কহিতে লাগিলেন, “কি বলিল? তিনি যুদ্ধক্ষেত্র হইতে পলায়ন করিয়াছেন? যিনি পলায়ন করিয়াছেন, তিনি ক্ষত্রিয় নহেন, তিনি আমার স্বামী নহেন,

৫৬