পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

স্তম্ভসারি উজ্জ্বল সুগন্ধ দীপাবলীতে ঝলমল করিতেছে মধ্যে ভোলানাথের প্রস্তর-বিনির্মিত প্রতিমূর্তি প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে। মন্দিরের একজন দীর্ঘকায় তেজস্বী জটাধারী গোস্বামী এক-প্রান্তে উপবেশন করিয়া আছেন, প্রশস্ত ললাটে অর্ধ-শশাঙ্কের ন্যায় চন্দনরেখা, বিশাল স্বন্ধে যজ্ঞোপবীত লম্বিত রহিয়াছে। অন্য দুই-চারি জন গোস্বামী এদিক ওদিক বিচরণ করিতেছেন। ঐ মন্দিরের প্রধান গোস্বামী চিরকাল অবিবাহিত থাকেন, তাঁহার মৃত্যুর পর শিষ্যের মধ্যে একজন ঐ পদে নিযুক্ত হন। মন্দিরের সাহায্যার্থে অনেকসংখ্যক গ্রাম নির্দিষ্ট ছিল, তাহা ভিন্ন যাত্রীদিগের দানও অল্প ছিল না।

 দ্বিপ্রহরের ঘণ্টারব সেই সুন্দর শিবমন্দিরে প্রতিধ্বনিত হইল বম্ বম্ হর হর শব্দে মন্দিরে পরিপূরিত লইল ও তৎপরে যন্ত্র সম্মিলিত উচ্চ গীতধ্বনিতে ভোলানাথের স্তব আরম্ভ হইল। প্রৌঢ়যৌবনসম্পন্না নর্তকীগণ তালে তালে নৃত্য করিতে লাগিল, গায়কগণ সপ্তস্বরে মহাদেবের অনন্ত গীত গাইতে আরম্ভ করিল। ক্ষণেক পরে গীত সাঙ্গ হইল, সেই জটাধারী গোস্বামী ইঙ্গিত করায় নর্তকীগণ চলিয়া গেল, গায়কগণ নিস্তব্ধ হইল, দীপাবলী নির্বাপিত হইল, পূজা সাঙ্গ হইল। নরেন্দ্রনাথ সে অন্ধকারে ইতিকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া দণ্ডায়মান হইয়া রহিলেন।

 ক্ষণেক পর বোধ হইল, যেন অন্ধকারে সেই থকায় জটাধারী গোস্বামী তাহাকে ইঙ্গিত করিতেছেন। নরেন্দ্রনাথ সেইদিকে যাইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয় কি এ মন্দিরের একজন গোস্বামী?” গোস্বামী কিছুমাত্র না বলিয়া ওষ্ঠের উপর অঙ্গুলি নির্দেশ করিলেন। তৎপরে গোস্বামী অঙ্গুলি দ্বারা দূরে এক দিক্‌ নির্দেশ করিলেন। নরেন্দ্র সেইদিকে চাহিলেন; নিবিড় দুর্ভেদ্য অন্ধকার ভিন্ন আর কিছুই দেখিতে পাইলেন না। আবার চাহিলেন, বোধ হইল যেন অন্ধকারে একটি দীপশিখা দেখা যাইতেছে। গোস্বামী নরেন্দ্রনাথকে ইঙ্গিত করিয়া অগ্রে অগ্রে চলিলেন নরেন্দ্রনাথ কিছুই বুঝিতে না পারিয়া পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন।

 দুইজনে অনেক পথ সেই অন্ধকারে অতিবাহিত করিলেন। এ অন্ধকারে এই মৌনাবলম্বী যোগীপুরুষ কে? ইহার উদ্দেশ্য কি? শৈবগণ কখন কখন নরহত্যার দ্বারা পূজাসাধন করে, এ দীর্ঘকায় বলিষ্ঠ বিকট যোগীর কি তাহাই উদ্দেশ্য? একবার নরেন্দ্রনাথ দাঁড়াইলেন, আবার খড়্গে হাত দিয়া ভাবিলেন, “আমি কি কাপুরুষ? এই প্রশান্তমূর্তি যোগীর সহিত যাইতে ভয় করিতেছি? আবার গোস্বামীর সঙ্গে সঙ্গে সেই দুর্ভেদ্য অন্ধকারে পথ অতিবাহন করিতে লাগিলেন। অনেকক্ষণ পর শৈব গোস্বামী এক পর্বতগহ্বরে প্রবেশ করিলেন। তাহার ভিতর যাহা দেখিলেন, তাহাতে নরেন্দ্র আরও বিস্মিত হইলেন। সম্মুখে করালবদনা কালীর ভীষণ প্রতিমূর্তি, তাহার নিকট কয়েকখানি

৬৪