পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 নরেন্দ্র। স্বামিন্। আপনি পরম ধার্মিক শৈব হইয়া আমাকে মুসলমান-ধর্ম অবলম্বন করিবার আদেশ করিতেছেন?

 শৈলেশ্বর। পাপের জন্য মনুষ্য গো-জন্ম পর্যন্ত প্রাপ্ত হয়, কেবল জাতিনাশে ভীত হইতেছ?

 দুইজনে অনেকক্ষণ নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। নরেন্দ্রনাথ হস্তে গণ্ডস্থল স্থাপন করিয়া সেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গের দিকে চাহিয়া একমনে চিন্তা করিতে লাগিলেন শৈলেশ্বর সেই পর্বতগহ্বরে ধীরে ধীরে বিচরণ করিতে লাগিলেন।

 অনেকক্ষণ পরে শৈলেশ্বর গম্ভীরস্বরে বলিলেন,—“নরেন্দ্রনাথ, তুমি আমাকে বিশ্বাস কর?”

 নরেন্দ্র। আমার খড়্গ গ্রহণ করুন, আর কি প্রমাণ দিব?

 শৈলেশ্বর। তবে একটি কথা শুন। প্রেম নারীর একমাত্র অবলম্বন, প্রেম নারীর জীবন; পুরুষের তাহা নহে। পুরুষের অনেক আশা, অনেক অভিলাষ, অনেক মহৎ উদ্দেশ্য আছে। তুমি যুবক, সাহসী, অভিমানী, এ প্রশস্ত জগতে কি আপন অসি সহায় করিয়া আপনার যশের পথ পরিষ্কার করিতে পার না? স্ত্রীলোকের মত কি কেবল ক্রন্দন করিয়া জীবন অতিবাহিত করিতে চাও? শুনিয়াছি, তোমাদের বঙ্গদেশ বীরশূন্য—যশশূন্য। যাও, নরেন্দ্রনাথ! সেই দূর বঙ্গদেশে যশোস্তম্ভ স্থাপন কর, যাও দেশের গৌরবসাধন কর, সিংহবীর্য প্রকাশ করিয়া আপন কীর্তি স্থাপন কর; এ মহৎ উদ্দেশ্যে তোমার জীবন সমর্পণ কর। আকাশে এরূপ দেবতা নাই; যিনি এ মহৎ উদ্দেশ্যে তোমার সহায়তা না করিবেন। স্বয়ং ব্রজপাণি পুরন্দর, স্বয়ং শূলপাণি মহাদেব তোমার মনস্কামনা পূর্ণ করিবেন।

 শৈলেশ্বর নিস্তব্ধ হইলেন। নরেন্দ্রের নয়নদ্বয় জ্বলিতে লাগিল। তিনি একদৃষ্টিতে সেই অপূর্ব শৈবের দিকে চাহিয়া রহিলেন। পূর্বে একদিন এই শৈবকে যেরূপ যুদ্ধনিপুণ দেখিয়াছিলেন অন্য মানবহৃদয়জ্ঞানে তাঁহাকে সেইরূপ নিপুণ দেখিলেন।

 শৈব আবার বলিতে লাগিলেন, “নরেন্দ্র। এই ঘোর রজনীতে তুমি বিদেশে ভগবান একলিঙ্গের মন্দিরে পূজা দিতে আসিয়াছ কি জন্য? দেশের হিতসাধনের জন্য আসিয়াছ? কোন্ বীরব্রতে ব্রতী হইয়া আসিয়াছ? কোন্ দেবোচিত মহদুদ্দেশ্যসাধনার্থ আসিয়াছ? ধিক্‌ নরেন্দ্র! তোমার ন্যায় বীরপুরুষ একটি বালিকার মুখ দেখিবার জন্য জীবনের মহৎ উদ্দেশ্য ভুলিয়া থাকে? প্রেমচিন্তা দূর কর; অথবা যদি প্রেম বিনা জীবন শুষ্ক বোধ হয় তবে বীরোচিত প্রণয়ে বদ্ধ হও। পুরুষসিংহ! সিংহী গ্রহণ কর।

 নরেন্দ্র। ভগবান। আদেশ করুন।

৬৮