পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চব্বিশ

 নরেন্দ্র অনেকক্ষণ সেই অন্ধকার গহ্বরে বিচরণ করিতে লাগিলেন, বাল্যকালের ভালবাসা, যৌবনের প্রেম সহসা উৎপাটিত করিতে প্রস্তুত হইয়াছেন। একাকী অনেকক্ষণ সেই গহ্বরে পদচারণ করিতে লাগিলেন। কী ভীষণ চিন্তায় তাঁহার হৃদয় উৎক্ষিপ্ত হইতেছিল, তাহা আমরা অনুভব করিতে সাহস করি না।

 অনেকক্ষণ পর অগ্নি নির্বাণপ্রায় দেখিয়া তিনি শৈবের আদেশ স্মরণ করিলেন, কলসে যে মদিরা ছিল, তাহা সমস্ত পান করিলেন। মস্তক ঘূর্ণিত হইতে লাগিল, অগ্নির একপার্শ্বে নরেন্দ্রনাথ শয়ন করিলেন।

 নরেন্দ্রনাথ অগ্নি দেখিতে লাগিলেন। এক-একবার কাষ্ঠের এক অংশ প্রদীপ্ত হয়, আবার নির্বাপিত হয়, এক-একটি স্ফুলিঙ্গ দেখা যায়, আবার অঙ্গার হইয়া যায়। দেখিতে দেখিতে জ্বলন্ত অঙ্গারগুলি প্রায় সমস্ত নির্বাপিত হইল, হীনতেজ আলোকে সেই শিলাগৃহের শিলাভিত্তি আরও অপরূপ দেখাইতে লাগিল। নরেন্দ্র সেই ভিত্তির উপর আলোক ও ছায়ার নৃত্যকে যেন অমানুষিক জীবের নৃত্য দেখিতে লাগিলেন, কালীর নয়নদ্বয় যেন ধক্-ধক্ করিয়া জ্বলিতে লাগিল। কালী-হস্তের খড়্গ যেন নরেন্দ্রের দিকে প্রসারিত হইতে লাগিল। নরেন্দ্র উঠিবার চেষ্টা করিলেন, উঠিবার শক্তি নাই। নরেন্দ্র জাগ্রত না সুপ্ত?

 অচিরাৎ শেষ অগ্নিকণা নির্বাণ হইল। নরেন্দ্র তাহা দেখিতেছিলেন না, তিনি স্বপ্ন দেখিতেছিলেন। এতক্ষণ দূরস্থ জলের শব্দ যাহা শুনা যাইতেছিল, নরেন্দ্রের বোধ হইল, যেন তাহা সহসা পরিবর্তিত হইয়া স্বর্গীয় সঙ্গীতধ্বনি হইল। গভীর অন্ধকারে যেন ক্রমে আলোকচ্ছটা বিকীর্ণ হইতে লাগিল। যে স্থানে গহ্বরের ভিত্তি ছিল, তথায় যেন একটি প্রস্তর সহসা সরিয়া যাইল, তাহার ভিতর হইতে অপূর্ব সঙ্গীতধ্বনি অপূর্ব চন্দ্রালোকের ন্যায় আলোক বাহির হইতে লাগিল। ক্রমে যেন চন্দ্রের যেন উপর হইতে মেঘ সরিয়া গেল, সে আলোকস্থান সম্পূর্ণ মুক্ত হইল। এ কি স্বপ্ন না যথার্থ? স্বর্গীয় রূপরাশি বিভূষিতা একটি ঘোড়শী বীণাহস্তে উপবেশন করিয়া অপূর্ব বাদ্য করিতেছে। নরেন্দ্র বিস্ময়ে স্তম্ভিত হইয়া সেই অপূর্ব স্বপ্ন দেখিতে লাগিলেন।

 কী অপুর্ব সৌন্দর্য, কী উজ্জ্বল নয়ন, কী কৃষ্ণ কেশপাশ, কী ক্ষীণ অঙ্গ। এ কি মানবী? নগেন্দ্রনাথ, ভাল করিয়া দেখ, এ বদনমণ্ডল, এ চারুনয়ন, এ ওষ্ঠ কি

৭০