পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 শৈলেশ্বর একগাছি রজ্জু বাহির করিলেন, নরেন্দ্রের দুই হস্ত সেই রজ্জু দ্বারা সজোরে বন্ধন করিলেন। এরূপ জোরে বাঁধিলেন যে, হন্তের শিরা স্ফীত হইয়া উঠিল। নরেন্দ্র শব্দমাত্র উচ্চারণ করিলেন না। পরে পুর্বের ন্যায় কলস লইয়া নরেন্দ্রের মুখের নিকট ধরিয়া মদ্যপান করিতে বলিলেন, নরেন্দ্র তাহাই করিলেন। গোস্বামী গহ্বর হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন।

 মত্ততাহেতু নরেন্দ্র অচিরাৎ ভূমিতে নিপতিত হইলেন, চক্ষুতে অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন, গহ্বরপার্শ্বে দুইজন যেন ধীরে ধীরে কথা কহিতেছে, এইরূপ তাহার বোধ হইতে লাগিল; শুনিতে শুনিতে নরেন্দ্র মদিরা প্রভাবে নিদ্রায় অভিভূত হইলেন, পরে কি হইল, স্মরণ রহিল না।

 কিন্তু সে নিদ্রা গভীর নহে। নরেন্দ্র সমস্ত রজনী স্বপ্ন দেখিতে লাগিলেন, কখন স্বপ্ন দেখেন, কখন অর্ধেক জাগ্রত হইয়া থাকেন। কখন স্বপ্ন দেখেন, জাগ্রত থাকেন, মত্ততাপ্রযুক্ত কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না।

 অনেকক্ষণ পরে বোধ হইল, যেন পূর্বের একদিনের ন্যায় আবার অন্ধকার হইতে আলোকচ্ছটা প্রকাশ হইতে লাগিল, আর যেন প্রস্তরভিত্তি সরিয়া গেল, মেঘ সরিয়া গেলে যেন চন্দ্রালোক প্রকাশিত হইল। সেই আলোকে সেই উজ্জল রমণী? কিন্তু জেলেখা অদ্য গান গাহিতেছে না, অদ্য বীণাহস্তে আইসে নাই, অদ্য খড়্গহস্তে!

 কী ভয়ঙ্করী মূর্তি। নয়ন হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বাহির হইতেছে, সুক্ষ্ম রক্তবর্ণ ওষ্ঠের উপর দন্ত চাপিয়া রহিয়াছে, সমস্ত বদনমণ্ডল ক্রোধপ্রোজ্বলিত ও রক্তবর্ণ। বামার করে সেই শৈশবের দীর্ঘখড়্গ, বামার বক্ষে একখানি তীক্ষ্ণ ছুরিকা। নরেন্দ্র বিস্মিত হইলেন, তাঁহার ললাট হইতে স্বেদ বহির্গত হইতে লাগিল। তিনি উঠিবার উদ্যম করিলেন, কিন্তু স্বপ্নে বিপদাপন্ন ব্যক্তির ন্যায় পলাইতে অক্ষম, উঠিতে অক্ষম।

 বামা মৃণাল-করে খড়্গ ধারণ করিয়া গহ্বরে প্রবেশ করিল। একবার দণ্ডায়মান হইল, একবার নরেন্দ্রের মুখের দিকে চাহিল। হস্ত হইতে খড়্গ পড়িয়া গেল।

 এবার সেই তীক্ষ্ণ ছুরিকা বাহির করিল, এবার অকম্পিত-হস্তে সে ছুরিকা নরেন্দ্রের বক্ষস্থলের উপর ধরিল। আবার কি চিন্তা আসিল, ছুরিকা হস্তভ্রষ্ট হইয়া পতিত হইল, বামা ধীরে ধীরে চলিয়া গেল।

 নরেন্দ্র চীৎকার শব্দ করিয়া উঠিয়া বসিলেন, তাহার নিদ্রাভঙ্গ হইল। তিনি দেখিলেন ঘর্মে তাঁহার সমস্ত শরীর আপ্লুত হইয়াছে, উন্মত্ততা গিয়াছে, গহ্বর অন্ধকার ও নিস্তব্ধ। ধীরে ধীরে তিনি গহ্বরের বাহিরে আসিলেন। রজনী অবসানপ্রায়, পূর্বদিকে রক্তিমচ্ছটায় আকাশ রঞ্জিত হইয়াছে। নির্বাণপ্রায় প্রদীপের ন্যায় দুই-একটি তারা

৭৫