পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ওমরাহদিগের মধ্যে বিবাহাদি কার্য হইলে তাহারা সঙ্গীত ও নৃত্য করিতে যাইত। শাজাহান তাহাদিগকে সর্বদাই নিকটে রাখিতে ভালবাসিতেন ও বেগমদিগের আলয়েও লইয়া যাইতেন। কিন্তু ইন্দ্রিয়সুখপরাঙ্মুখ আওরংজীব তাহাদিগকে প্রায় নিকটে আসিতে দিতেন না, তবে আজি আনন্দের দিনে কঞ্চনীগণ কেন না সমাদৃত হইবে?

 তাহার পর দুর্গেব পূর্বদিকে অর্থাৎ যমুনাতীরে মল্লযুদ্ধ, অসিযুদ্ধ প্রভৃতি নানারূপ যুদ্ধ হইতে লাগিল। প্রাসাদের উপর হইতে বেগমগণ দেখিতে পাইবেন, এইজন্য এইস্থলে যুদ্ধ হইত। অবশেষে দুইটি মত্ত হস্তীর যুদ্ধ আরম্ভ হইল। মধ্যে আন্দাজ দুই হাত উচ্চ একটি মৃত্তিকার প্রাচীর তাহার দুইদিক হইতে দুই মত্ত হস্তী মাহুত দ্বারা পরিচালিত হইয়া রণে লিপ্ত হইল। অনেকক্ষণ যমুনার উভয় পার্শ্ব হইতে লোক সবিস্ময়ে এই ভীষণ যুদ্ধ দেখিতে লাগিল। শুণ্ডের চপেটাঘাতে ও দন্তজনিত আঘাতে হস্তীদ্বয়ের মস্তক ও শরীর ক্ষতবিক্ষত হইয়া যাইল। প্রত্যেক ইস্তীর দুইজন করিয়া মাহুত ছিল; একটি হস্তীর একজন মাহুত পড়িয়া গেল, সহসা হস্তী দ্বারা পদদলিত হইয়া জীবন ত্যাগ করিল; অপর পক্ষের একজন মাহুতের ঐরূপে জন্মের মতো হাত ভাঙিয়া গেল। এই হতভাগারা এই জীবনের আশা পরিত্যাগ করিয়াই হস্তীদ্বয়কে যুদ্ধে প্রমত্ত করিয়াছিল, বহু অর্থলোভে স্ত্রী-পুত্র-সকলের নিকট বিদায় পূর্বেই লইয়া আসিয়াছিল। অনেকক্ষণ যুদ্ধের পর একটি হস্তী অন্যকে পরাস্ত করিয়া, মৃত্তিকা-প্রাচীর উল্লঙ্ঘন করিয়া পশ্চাদ্ধাবমান হইল। তাহাদিগকে ছাড়াইবার জন্য অনেকে চরকি প্রভৃতি আগুনের বাজী ছুঁড়িল, কিন্তু সঞ্জাত-ক্রোধ হস্তী তাহাতে নিরস্ত না হইয়া অপর হস্তীর পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিল, অবশেষে পরাজিত হস্তী সন্তরণ করিয়া যমুনা পার হইয়া গেল, পথিমধ্যে দুই-একজন লোক যাহার সম্মুখে পড়িল তাহারাও নিহত হইল।

 এ সমস্ত আমোদ দেখিয়া নরেন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে যমুনা-পুলিনে যাইলেন ও হস্তমুখ প্রক্ষালন করিয়া একটি সুন্দর বৃক্ষমূলে শয়ন করিলেন। যেস্থানে নরেন্দ্রনাথ শয়ন করিলেন সেটি অতি মনোহর স্থল। বিশাল তমাল-বৃক্ষ সূর্যের কিরণ নিবাবণ করিতেছে ও বৃক্ষের উপর হইতে দুই-একটি পক্ষী যেন দিনের তাপে ক্লিষ্ট হইয়া অতি মৃদুস্বরে ডাকিতেছে। নিকটে বৃক্ষের একপার্শ্বে একটি পুরাতন কবর আছে প্রস্তর স্থানে বিদীর্ণ হইয়া গিয়াছে ও অশ্বত্থ প্রভৃতি বৃক্ষলতাদি সেই কবরের উপর জন্মিয়াছে। কবরের একপাশে পারস্য ভাষায় একটি বায়েৎ লেখা আছে, অহার অর্থ “বন্ধু। আমার নাম জানিবার আবশ্যক কি? আমি জগতে অভাগা, অসুখী ছিলাম। তুমি যদি হতভাগা হও আমার জন্য একবিন্দু অশ্রুবর্ষণ করিও।” মন্দ মন্দ যমুনাবায়ু হইতে শীতল স্থানকে

৭৯