পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বলবান্ হয় না, দয়া অপেক্ষা কৃতজ্ঞতা দুর্বল ও ক্ষণভঙ্গুর। নবকুমারের কৃতজ্ঞতা শীঘ্র ভাঙিয়া গেল।

 নবকুমার নিতান্ত মন্দ লোক ছিলেন না, কিন্তু নবকুমার দরিদ্র, ঘটনাস্রোতে সমস্ত জমিদারি প্রাপ্তির আশা তাঁহার হৃদয়ে জাগরিত হইল। সে লোভ দরিদ্রের পক্ষে দুর্দমনীয়। বীরেন্দ্রের পুত্র অতি শিশু, বীরেন্দ্রের পূর্বেই মৃত্যুগ্রাসে পতিত হইয়াছিলেন, শিশুর বিষয় রক্ষা করে, এরূপ জ্ঞাতি-কুটুম্ব কেহ ছিল না, দুই-একজন যাঁহারা ছিলেন, তাহারাও নবকুমারের সহিত যোগ দিলেন। সংসারে যাঁহারা বীরেন্দ্রের অভিভাবক ছিলেন, তাঁহারা কিছুই জানিলেন না অথচ জানিয়া কি করিবেন?

 তথাপি নবকুমার সমস্ত জমিদারি একাকী লইবেন, প্রথমে এরূপ উদ্দেশ্য ছিল না, বীরেন্দ্রের জীবদ্দশাতেই দুই-পাঁচখানি গ্রাম আপন নামে করিয়াছিলেন, এখন আরও দুইপাঁচখানি গ্রাম আপন নামে করিতে লাগিলেন। ক্রমে লোভ বাড়িতে লাগিল। ভাবিলেন, আমার একমাত্র কন্যা হেমের সহিত নরেন্দ্রের বিবাহ দিব, অবশেষে বীরেন্দ্রের জমিদারি তাঁহার পুত্রেরই হইবে, এখন নাবালকের নামে জমিদারি থাকিলে গোলমাল হইতে পারে, সম্প্রতি আপন নামে থাকাতে বোধ হয় কোন আপত্তি হইতে পারে না। এই প্রকার চিন্তা করিয়া তদনুসারে কার্য করিতে লাগিলেন।

 তৎকালে সুবাদারের সভাতে প্রধান প্রধান জমিদার ও জায়গীরদারদিগের এক একজন উকীল থাকিত। তাহারা নিজ নিজ মনিবেব পক্ষ হইতে মধ্যে মধ্যে নজর দিয়া সুবাদারের মন তুষ্ট রাখিত ও মনিবের পক্ষ হইতে আবেদন আদি সমস্ত কার্য নির্বাহ করিত। সদরে এইরূপে একটি একটি উকীল না থাকিলে জমিদারির বিশেষ অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা ছিল।

 বীরনগর জমিদারির উকীল এক্ষণে নবকুমারের বেতনভোগী। তিনি বঙ্গদেশের কানঙ্গু মহাশয়ের নিকট আবেদন করিলেন যে, বীরেন্দ্রের মৃত্যু হইতে জমিদারির খাজনা নিয়মিতরূপে আসিতেছে না, তবে নবকুমার নামে একজন কার্যদক্ষ লোক সেই জমিদারির ভার লইয়া আপন ঘর হইতে যথাসময়ে খাজনা দিতেছে। নবকুমার বীরেন্দ্রের বিশেষ আত্মীয় ও বীরেন্দ্রের পরিবারকে প্রতিপালন করিতেছে। আবেদনসহ পঞ্চ সহস্র মুদ্রা কানঙ্গু মহাশয়ের নিকট উপঢৌকন গেল। আবেদনের বিরুদ্ধে কেহ দণ্ডায়মান ছিল না, তৎক্ষণাৎ বীরেন্দ্রের নাম খারিজ হইয়া নবকুমারের নাম লিখিত হইল। অদ্য নবকুমার মিত্র বীরনগরের জমিদার।

 জমিদারের হৃদয়ে নূতন নূতন ভাবের আবির্ভাব হইতে লাগিল। যে নরেন্দ্রের পিতাকে পূর্বে পূজা করিতেন, যে নরেন্দ্রকে এতদিন অতিযত্নে পালন করিয়াছেন, অদ্য সেই নরেন্দ্র তাঁহার চক্ষুর শূল হইল। নবকুমারের সাক্ষাতে না হউক, অসাক্ষাতে সকলেই