পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 জেলেখা। প্রাসাদে যাইবার আমার অধিকার না থাকিলে তোমাকে আসিতে বলিতাম না।

 নরেন্দ্র। তথাপি তুমি কে জানি না, অজ্ঞাত স্থানে যাইব না।

 জেলেখা কর্কশস্বরে বলিল, “মৃত্যুভয় করিতেছ? তোমাকে হনন করিবার ইচ্ছা থাকিলে, আমি তাতারদেশীয়া, আমি এই ছুরিকা এতক্ষণ ব্যবহার করিতে পারিতাম না? কিন্তু এই লও, ছুরিকা ত্যাগ করিলাম, রিক্তহস্ত স্ত্রীলোকের সহিত যাইতে বোধ হয় বীর-পুরুষের কোন আপত্তি নাই।”

 জেলেখার বিকট হাস্যধ্বনিতে নরেন্দ্রর মুখমণ্ডল ক্রোধে বক্তবর্ণ হইল। তিনি নিঃশব্দে জেলেখার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইতে লাগিলেন। ক্ষণেক যাইলে পর জেলখা একস্থানে কতকগুলি বস্ত্র দেখাইয়া নরেন্দ্রকে তাহা পরিধান করিতে কহিল। নরেন্দ্র তুলিয়া দেখিলেন, তাহা তাতারদেশীয় রমণীর পরিচ্ছদ। বিস্মিত হইয়া আবার জেলেখার দিকে চাহিলেন। জেলেখা এবার গম্ভীরস্বরে বলিল, “বিলম্ব করিও না, আমরা যে দ্বার দিয়া আসিয়াছি, এক্ষণে সে দ্বার রূদ্ধ হইয়াছে, চারিদিকে খোজাগণ নিষ্কাষিত অসিহস্তে দণ্ডায়মান রহিয়াছে। এ বেগমদিগের প্রাসাদ, তুমি পুরুষ জানিলে এইক্ষণেই তোমার প্রাণ-বিনাশ করিবে।”

 নরেন্দ্র বিস্ময়াপন্ন হইয়া দেখিলেন, জেলেখার কথা সত্য। অগত্যা নরেন্দ্র কাঁচলি ও ঘাগরা পরিলেন, জেলেখা হাসিতে হাসিতে তাঁহাকে পরচুলা পরাইয়া দিয়া মস্তকের উপর খোঁপা করিয়া দিল। নরেন্দ্র এই অদ্ভুত বেশে জেলেখার সঙ্গে সঙ্গে প্রাসাদের অন্তঃপুরে চলিলেন।

 নরেন্দ্র জেলেখার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন; কত গৃহ ও পথ অতিবাহিত করিলেন তাহা গণনা করা যায় না। দ্বারে দ্বারে অসিহস্তে খোজাগণ দণ্ডায়মান বহিয়াছে ও শত-শত পরিচারিকা এদিক-ওদিক পরিভ্রমণ করিতেছে। জেলেখাকে দেখিয়া সকলেই দ্বার ছাড়িয়া দিল।

 নরেন্দ্রনাথ বেগমদিগের মহলের অভ্যন্তরে যত যাইতে লাগিলেন, ততই বিস্মিত হইলেন—ঐশ্বর্য, শিল্পকার্য ও বিলাসপ্রিয়তার পরাকাষ্ঠা দেখিয়া বিস্মিত হইলেন। শ্বেতমর্মরপ্রস্তর-বিনির্মিত কত ঘর, কত প্রাঙ্গণ, কত সুন্দর স্তম্ভসারি, কত উন্নত ছাদ, তাহা গণনা করা যায় না। সেই প্রস্তরে কী অপূর্ব শিল্পকার্য! দেওয়ালে স্তম্ভে প্রকোষ্ঠে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের প্রস্তর শ্বেতপ্রস্তরে সন্নিবেশিত হইয়া লতা, পত্র, বৃক্ষ, পুষ্পের রূপ ধারণ করিয়াছে, যেন সুন্দর শ্বেত দেওয়ালের পার্শ্বে যথার্থই পুষ্প ফুটিয়া রহিয়াছে। ছাদ হইতে যেন সেইরূপ পুষ্প লম্বিত রহিয়াছে। অথবা উজ্জ্বল সুবর্ণমণ্ডিত ও চিত্রিত হইয়া,

৮১

 মাধবীকঙ্কণ—৬