পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

অধিকতর শোভা ধারণ করিতেছে। শেতপ্রস্তর-বিনির্মিত সুন্দর গবাক্ষ, সুন্দর ফোয়ারা, সুন্দর পুষ্পাধার তাহার উপর মনোহর সুগন্ধ পুষ্প ফুটিয়া প্রাসাদকে আমোদিত করিতেছে। শ্বেত, পীত বর্ণের আলোকে সেই রঞ্জিত ঘরের ভিতর ও বাহির দেখা যাইতেছে। জগতে অতুল্য রূপবতী বেগমগণ কেহ বা সেই ঘরে বা প্রকোষ্ঠে ভ্রমণ করিতেছেন, কেহ বা পুষ্পচয়ন করিয়া কেশে ধারণ করিতেছেন, কেহ বা আনন্দে গান করিতেছেন। আজ আনন্দের দিন, রাজপ্রাসাদ আনন্দ ও নৃত্যগীতে পরিপূর্ণ।

 এই সমস্ত দেখিতে দেখিতে নরেন্দ্র যেখানে স্বয়ং আওরংজীব ছিলেন তথায় যাইয়া উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন সম্রাট আওরংজীব বেগমদিগের সহিত পঁচিশী খেলিতেছেন। পঁচিশী ঘর শ্বেতপ্রস্তর-বিনির্মিত ও প্রকাণ্ড; এক-একটি রূপবতী কামিনী এক একটি ঘুঁটি। ঘুঁটি ভিন্ন-ভিন্ন বর্ণের হওয়া আবশ্যক, এইজন্যই কামিনীগণ ভিন্ন-ভিন্ন বর্ণেব পরিচ্ছদ ধারণ করিয়াছেন।

 তথা হইতে নরেন্দ্র জেলেখার সঙ্গে একটি মর্মর প্রস্তর বিনির্মিত ঘরে প্রবেশ করিলেন মর্মরপ্রস্তর-বিনির্মিত স্তম্ভসারি সাটিন ও মখমলে বিজড়িত নানাবর্ণের গন্ধদীপ আলোক ও সৎগন্ধদানে ঘর আমোদিত করিতেছে। ভিতরে তিন-চারিজন বেগম বাদ্য ও গীত করিতেছেন, সপ্তস্বর মিলিত সেই গীতধ্বনি উন্নত ছাদ উল্লঙ্ঘন করিয়া যমুনাতীরে ও নৈশগগনে প্রধাবিত হইতেছে।

 সে গৃহ হইতে কিছু দূরে যমুনা নদীর দিকে একটি শ্বেতপ্রস্তর-নির্মিত বারান্দায় সুন্দর চন্দ্রালোক পতিত হইয়াছে। এ স্থানটি নিস্তব্ধ ও রমণীয়। উপরে আকাশে নীলবর্ণ, দুই-একটি তারা দেখা যাইতেছে। শারদীয় চন্দ্র সুধাবর্ষণ করিয়া গগনকে শোভিত ও জগৎকে তৃপ্ত করিতেছে। নীচে নীলবর্ণ যমুনা নদী কল-কল শব্দে প্রধাবিত হইতেছে, তাহার চন্দ্রকরোজ্জ্বল বৃক্ষের উপর দুইখানি ক্ষুদ্র পোত ভাসমান রহিয়াছে। দক্ষিণে সুন্দর তাজমহল চন্দ্রকরে অধিকতর সুন্দর দেখা যাইতেছে। বারান্দা জনশূন্য, কেবল একজন রাজদাসী বীণাহস্তে গান করিতেছিল, এক্ষণে পরিশ্রান্ত হইয়া বারান্দায় শ্বেতপ্রস্তরে মস্তক রাখিয়া বোধ হয় সুখের বা দুঃখের স্বপ্ন দেখিতেছে। যমুনার বায়ু রমণীর চন্দ্রকরোজ্জল কেশপাশ লইয়া ক্রীড়া করিতেছে অথবা সে বীণার উপর কখন কখন সুখের গান করিতেছে। বারান্দায় দণ্ডায়মান হইয়া ও যমুনার সুন্দর গান ও শীতল বাযু ভোগ করিয়া নরেন্দ্রের হৃদয়ে নব নব ভাব উদিত হইতে লাগিল। এইরূপ নিস্তব্ধ রজনীতে এইরূপ নদীতীরে নরেন্দ্র দূরবঙ্গদেশে হেমকে শেষবার দেখিয়াছিলেন। আহা! সে সুন্দর মুখখানি চন্দ্র হইতেও সুধাপূর্ণ ও জ্যোতির্ময়। মুহূর্তের জন্য নরেন্দ্রের হৃদয় হেমলতাপুর্ণ হইল,

৮২