পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

নরেন্দ্র আকাশের দিকে চাহিয়া চাহিয়া একটি দীর্ঘশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া অন্যদিকে যাইলেন।

 যেদিকে যাইবেন, সেদিক হইতে লোকের কলরব শুনিতে পাইলেন। প্রাসাদের মধ্যে এই কলরব শুনিয়া নরেন্দ্র কিছু বিস্মিত হইলেন এবং ঔৎসুক্যের সহিত সেইদিকে গমন করিতে লাগিলেন। যত নিকট আসিলেন, ততই নারীকণ্ঠনিঃসৃত সুমধুর কথা ও হাস্যধ্বনি তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করিল; তিনি আরও বিস্মিত হইয়া সেইদিকে যাইয়া অবশেষে একটি জনাকীর্ণ স্থানে উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন সম্মুখে একটি অতি বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণ; প্রাঙ্গণে কত সুন্দর পুষ্পচারা পুষ্পলতিকা, তাহা বর্ণনা করা যায় না। চতুষ্পার্শ্বস্থ হর্ম্যশ্রেণী হইতে পুষ্পমালা দুলিতেছে বৃক্ষলতায় পুষ্প ফুটিয়া রহিয়াছে, স্থানে স্থানে স্তূপাপাকার পূষ্প রহিয়াছে, চারিদিকে সুগন্ধ পুষ্প-বিকীর্ণ রহিয়াছে। সুদর্শন ফোয়ারা যেন দ্রব রৌপ্যস্তম্ভ নৈশ আকাশে উত্তোলন করিয়া আবার মুক্তারূপে চারিদিকে বিকীর্ণ করিতেছে। ঝোপে, বৃক্ষের অন্তরালে, সম্মুখে, পার্শ্বে, উচ্চে, নানাবর্ণের সুগন্ধ দীপাবলী জ্বলিতেছে, যেন আজ ইন্দ্রের অমরাপুরী লজ্জিত করিয়া এই বেগমমহল অপূর্ব রূপ ধারণ করিয়াছে। সেই প্রাঙ্গণে একটি বাজার বসিয়াছে, ক্রেতা-বিক্রেতা দলে দলে বিচরণ করিতেছে। অন্যান্য বাজার হইতে এই ভেদ যে, সকলেই রমণী। বিক্রেতা ভারতবর্ষের প্রধান প্রধান রাজা, মহারাজা ওমরাহগণের মহিলাগণ,—ক্রেতা সম্রাটের বেগমগণ। যে সমস্ত অসূর্যম্পশ্যা কোমলাঙ্গী লাবণ্যময়ী যুবতীগণ ক্রয়-বিক্রয় করিতেছেন তাহাদিগের হাবভাব রসিকতা ও বাক্-প্রগল্‌ভতায় নরেন্দ্র চমকিত হইলেন।

 পাঠকগণ অবগত আছেন যে বৎসর-বৎসর নওরোজার দিন দিল্লীর সম্রাটগণ বেগমমহলে একটা করিয়া বাজার বসাইতেন, ভারতবর্ষের প্রধান প্রধান মহিলাগণ এই বাজারে দ্রব্য বিক্রয় করিতে আসিতেন। ওমরাহ ও রাজাগণ পরিবারস্থ রমণীদিগকে বেগমদিগের সহিত পরিচিত করিবার জন্য এই বাজারে পাঠাইতেন। পুরুষের মধ্যে কেবল স্বয়ং সম্রাট আসিতেন; পূর্ব প্রথামতে এই আনন্দের দিনে আওরংজীব সেইরূপ বাজার বসাইয়াছেন ও স্বয়ং দুই-একজন বেগমের সহিত এক দোকান হইতে অন্য দোকানে পরিভ্রমণ করিতেছিলেন। ভ্রাতৃযুদ্ধে আওরংজীবের ভগিনী রোশন-আরা আওরংজীবের অনেক সহায়তা করিয়াছিলেন, সে বাজারের মধ্যে রোশন-আরার ন্যায় কাহার গৌরব, কাহার প্রভুত্ব। অন্য ভগিনী জেহান-আরা দারার পক্ষাবলম্বন করিয়াছিলেন, অন্য এ মহোৎসবের মধ্যে জেহান-আরা নাই।

 বিস্ময়োৎফুল্ল লোচনে নরেন্দ্রনাথ এই মহোৎসব দেখিতে লাগিলেন। দেখিলেন সম্রাট একজন রূপবতী মোগলকন্যার নিকটে কতকগুলি অলঙ্কার ও সাটিন্ ও সুবর্ণখচিত

৮৩