পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বীরগ্রামে আসিয়াই হেমলতার অন্তরের ভাব কিছু কিছু বুঝিতে পারিল মনে মনে সঙ্কল্প করিল “যদি বালিকাকে আমি যত্ন না করি, বোধ হয় ভ্রাতার সংসার ছারখার হইয়া যাইবে।” শৈবলিনী সেই অবধি বীরগ্রামে রহিল।

 শৈবলিনীর সস্নেহ ব্যবহারে ও প্রবোধবাক্যে হেমলতার দুঃখভাব কিঞ্চিৎ হ্রাস পাইল। শৈবলিনী মানবচরিত্র বিশেষ বুঝিত, একবারও হেমকে তিরস্কার করিত না, কনিষ্ঠা ভগিনীকে যেন প্রবোধ-বাক্যে সান্ত্বনা করিত। তাহার সারগর্ভ স্নেহপরিপূর্ণ কথায় কোন্ দুঃখীর দুঃখ না বিদূরিত হয়। শৈবলিনী গল্প করিতে অতিশয় পটু, সর্বদাই হেমলতাকে পুরাণের গল্প বলিত। সে পবিত্র মুখে পবিত্র গল্প শুনিতে শুনিতে হেমলতার রজনীতে নিদ্রা বিস্মরণ হইত। গভীর রজনী, গভীর বন, চারিদিকে বৃক্ষের অন্ধকার দেখা যাইতেছে, বায়ুর শব্দ ও হিংস্র জন্তুর নাদ শুনা যাইতেছে। রাজকন্যা দয়মন্তী অদ্য স্বামীর প্রেমকে একমাত্র অবলম্বন করিয়া ধন মান রাজ্য তুচ্ছ জ্ঞান করিয়া, সুখে জলাঞ্জলি দিয়া, ভিখারিণীর বেশে বিচরণ করিতেছে। স্বামী তৃষ্ণার্ত হইলে গণ্ডুষ করিয়া জল দিতেছে, স্বামী বস্ত্রহীন হইলে আপন বস্ত্র দিতেছে স্বামী পরিশ্রান্ত হইলে আপন অঙ্কে তাঁহার মস্তক স্থাপন করিয়া স্বয়ং অনিদ্র হইয়া উপবেশন করিয়া আছে। সেই স্বামী যখন মায়া বিচ্ছিন্ন করিয়া অভাগিনীকে ত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইল তখনও অভাগিনীর স্বামী-চিন্তা ভিন্ন এ জগতে আর চিন্তা নাই, স্বামীর পুনর্মিলন ভিন্ন এ জগতে আর আশা নাই।

 অথবা সেই মহর্ষি বাল্মীকির কুটীরে চিরদুঃখিনী বৈদেহী হস্তে গণ্ডস্থাপন করিয়া এখনও হৃদয়েশ্বরকে চিন্তা করিতেছে। সম্মুখে পুত্র দুইটি খেলা করিতেছে তাহাদিগের মুখ অবলোকন করিতেছে, আবার শ্রীরামের চিন্তা করিতেছে। যিনি নিরাশ্রয়া, নিষ্কলঙ্কা, অন্তঃস্বত্ত্বা রাজকন্যা, রাজরানী চিরনির্বাসিত করিয়াছেন, সেই নিষ্ঠুর পতিকেও অদ্যাবধি হৃদয়ে স্থান দিয়া অভাগিনী চিন্তা করিতেছে সেই পতিই সীতার জীবনের জীবন, হৃদয়ের সর্বস্ব ধন। পতিব্রতার কী মাহাত্ম্য?

 রজনী তৃতীয় প্রহর পর্যন্ত হেমলতা তাহার ধর্মপরায়ণা ননদিনীর নিকট এই সকল পুণ্যকথা শুনিত। দুঃখকথা শুনিয়া হেমলতার হৃদয় আলোড়িত হইত, ননদিনীর হৃদয়ে বদন ঢাকিয়া দরবিগলিত ধারায় রোদন করিত; আবার মুখ তুলিয়া সেই পবিত্র কথা শুনিত, আবার শোকাকুলা হইয়া অবারিত অশ্রুজল ত্যাগ করিত। হেমলতা ভাবিত সংসারে সকলেই দুঃখিনী, পুণ্যাত্মা সীতা দুঃখিনী, ধর্মপরায়ণা সাবিত্রী দুঃখিনী, আমি কি অভাগিনী যে নিজ দুঃখবিহ্বলা হইয়া রহিয়াছি। তাঁহারা সাধ্বী ছিলেন, পতিব্রতা ছিলেন, অভাগিনী হেমলতা আজও নরেন্দ্রের চিন্তা করে, দেবতুল্য স্বামীকে

৮৭