পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 স্ত্রীলোকের মনে একবার সন্দেহ উদয় হইলে তাহা শীঘ্র তিরোহিত হয় না। দিবারাত্র তোমার হেমের কথা জানিতে উৎসুক থাকিতাম, তোমার কাগজপত্র চুরি করিয়া পড়াইয়া লইতাম, কথায় কথায় তোমার নিকট হইতে বীরনগরের সমস্ত কথা বাহির করিয়া লইতাম। তখন তোমার হেমকে তোমার মন হইতে দূর করিয়া সেই স্থান অধিকার জন্য আমার হৃদয় জ্বলিতে লাগিল।

 তোমার হিন্দু ধর্মে আস্থা দেখিয়া আমি একলিঙ্গ-মন্দিরের গোস্বামীদিগের নিকট আপনার ইষ্টলাভের জন্য যাইতাম। প্রথমে যাঁহার নিকট যাইলাম, তিনি পরম তেজস্বী ও ধার্মিক, আমার সমস্ত প্রস্তাব শুনিয়া আমাকে পদাঘাত করিয়া তাড়াইয়া দিলেন। এইরূপে তিন চারিজনের নিকট অপমানিত হইয়া অবশেষে সেই শৈলেশ্বরের নিকট যাইলাম। তিনি অনেক অর্থলোভে সম্মত হইলেন। আমি তৎক্ষণাৎ তিন শত মুদ্রার একটি হীরক-বলয় তাঁহার হাতে দিলাম আর সহস্র মুদ্রার একটি মুক্তামাল্য তাঁহার সম্মুখে দোলাইয়া বলিলাম, “যদি ছলে বলে কৌশলে নরেন্দ্রকে হেমলতার চিন্তা ত্যাগ করাইতে পার, মুসলমান ধর্ম অবলম্বন করাইতে পার, আমাকে গ্রহণ করাইতে পার, তবে এই মুক্তাহার তোমার গলায় স্বহস্তে পাইয়া দিব।”

 এত অর্থ কোথায় পাইলাম, জিজ্ঞাসা করিবে? জেহান-আরার দাসদাসীরও অর্থের অভাব ছিল না। দেশের বড় বড় লোক সম্রাটের নিকট কোন আবেদন করিতে আসিলে বেগম-সাহেবাকে উপঢৌকন না দিলে কোন কার্যই সম্পাদিত হইত না। কেহ একটি উচ্চকর্মের প্রার্থী, কেহ একটি বিষয়ের প্রার্থী, কেহ প্রজার উপর অত্যাচার করিয়াছেন, তাহার ক্ষমা চাহেন, কেহ পরের জায়গীর কাড়িয়া লইয়াছেন, তাহার একটি সনন্দপত্র চাহেন, কোন যোদ্ধা যুদ্ধে পরাস্ত হইয়াছেন, তাহার ক্ষমাপ্রার্থী, কাহারও উপর সম্রাটের অন্যায় ক্রোধ হইয়াছে, সে ক্রোধ হইতে নিস্তার পাওয়া আবশ্যক; সকলেই রাশি রাশি হীরা মুক্তা ও অর্থ বেগম-সাহেবার নিকট পাঠাইয়া দিয়া আপন আপন আবেদন জানাইতেন। বেগম-সাহেবার দাসীরাও অর্থে বঞ্চিত হইত না।

 তাহার পর শৈলেশ্বর যে যে উপায় অবলম্বন করিয়াছিলেন, তাহা তুমি জান। সে উপায় বিফল হইল, আমার আশা বিফল হইল। দুই দিন পর্বতগহ্বরে নিজে নারীবেশে তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলাম, তুমি সুরায় উন্মত্ত ছিলে, দেখিয়াছিলে কি না জানি না। প্রথম দিনে তোমার পদতলে পড়িয়া রোদন করিয়াছিলাম, দ্বিতীয় দিবস তোমার প্রাণসংহারে উদ্যত হইয়াছিলাম। হস্ত হইতে খড়্গ পড়িয়া গেল, তাতারের হস্ত হইতে খড়্গ পড়িয়া যায়, কখনও জানিতাম না, আমি এরূপ ক্ষীণ, তাহা জানিতাম না।

৯৫