পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৯৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 পরে তোমার সহিত পুনরায় আগ্রায় আসিলাম, অনুসন্ধানে জানিলাম, বঙ্গদেশ হইতে একজন ধনাঢ্য জমিদার আসিয়াছে,—তোমর হেমকে দেখিলাম। পাপিষ্ঠা! পরস্ত্রী তোমার হেম। উঃ, আর যাতনা সহ্য করিতে পারি না। তিন দিন পর মথুরার গোলোকনাথের মন্দিরে এক-প্রহর রাত্রির সময় যাইও, পরস্ত্রীকে আবার দেখিও। তুমি আমাকে হতভাগিনী করিয়াছ, তোমাকেও হতভাগা করিব, সেইজন্য এই সমাচার দিলাম। সেইজন্য আগ্রার দুর্গে লইয়া যাইয়া হেমকে দেখাইয়াছিলাম।

 আমার মৃত্যু সন্নিকট, জিঘাংসা তাতারের ধর্ম, আমি অধর্ম ভুলি নাই, আমার শোণিত শীতল হয় নাই।

 উঃ! আমার মস্তক ঘুরিতেছে। যদি এ তৃষ্ণাকে স্নেহবারি দান করিতে, তবে মুসলমানী অকৃতজ্ঞ হইত না, যতদিন জীবিত থাকিত—কিন্তু সে কথায় আর কাজ কি নরেন্দ্র! এ জীবনের জন্য বিদায় দাও, যদি মৃত্যুর পর আর একবার দেখা হয়, নিষ্ঠুর নরেন্দ্র! এই হৃদয় বিদীর্ণ করিয়া অন্তরের ভাব তোমাকে দেখাইব। নরেন্দ্র। যখন তুমি আমাকে ভালবাসিবে—নতুবা এই ছুরিকা দ্বারা তোমার পাষাণ হৃদয় চূর্ণ করিব!

—উন্মাদিনী জেলেখা

 পত্র পাঠ সমাপ্ত হইল। নরেন্দ্রের নয়ন হইতে দুই-একবিন্দু অশ্রুবারি পড়িল। তিনি নিস্তব্ধে চিন্তা করিতে করিতে গৃহ হইতে বাহির হইলেন। রজনী প্রায় শেষ হইয়াছে, সমস্ত নগর নিস্তব্ধ। নরেন্দ্র পদচারণা করিতে করিতে অনেক দূর যাইয়া পড়িলেন, দেখিলেন সম্মুখে যমুনা।

 একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া নরেন্দ্র প্রত্যাগমন করিতে ছিলেন, এরূপ সময়ে দেখিলেন, যমুনাতীরে একস্থানে কতকগুলি লোক সমবেত হইয়া একটি মৃতদেহ ভূমিতে সন্নিবেশিত করিতেছে। জিজ্ঞাসা করায় সেই লোকের মধ্যে একজন উত্তর দিল, “মৃত ব্যক্তি পুর্বে বেগম মহলের দাসী ছিল। একজন কাফের সৈনিকের সহিত ব্যাভিচারিণী হইয়া বাহির হইয়া যায়। বোধ হয়, সে সৈনিক উহাকে এক্ষণে হত্যা করিয়াছে, দাসীর বক্ষস্থলে এই তীক্ষ ছুরিকাঘাত বসান দেখিলাম। হতভাগিনীর নাম জেলেখা।”

তেত্রিশ

 সায়ংকালে শান্তপ্রবাহিনী যমুনাকূলে মথুরা নগরী বড় সুন্দর দেখাইতেছিল। সূর্য অনেকক্ষণ অস্ত গিয়াছে, গগনে নক্ষত্র এক একটি করিয়া প্রস্ফুটিত হইতেছে, যমুনার বিশাল বক্ষের উপর দিয়া সন্ধ্যার বায়ু রহিয়া রহিয়া বহিয়া যাইতেছে, সমস্ত জগৎ শীতল ও শান্ত। মথুরায় প্রস্তর-বিনির্মিত ঘাটশ্রেণী জল পর্যন্ত নামিয়াছে। বৃক্ষ ও কুঞ্জবনের ভিতর দিয়া মথুরার গোলোকনাথের মন্দির দেখা যাইতেছে।

৯৬