পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

দেবপূজা সাঙ্গ করিলাম, এই পূণ্যভূমিতে দাঁড়াইয়া এই পূণ্য দেবমন্দিরে আমি অবিশ্বাসিনী হইব না। যদি আমার প্রধান দেবতুল্য স্বামী আমাকে ভালবাসেন, আমার জীবনের যিনি সর্বস্বধন, জীবন থাকিতে এ দাসী তাঁহার অবিশ্বসিনী হইবে না। দিদি, আমাকে সন্দেহ করিও না, আমাকে মন্দ ভাবিও না, তুমি আমাকে মন্দ ভাবিলে এ সংসারে অভাগিনীকে কে ভালবাসিবে?”

 হেমলতার নয়ন হইতে ঝর-ঝর করিয়া জল পড়িয়া সমস্ত মুখমণ্ডল সিক্ত হইতেছিল।

 তখন শৈবলিনীর মন শান্ত হইল, শৈবলিনীরও চক্ষুতে জল আসিল। শৈবলিনী সস্নেহে হেমের চক্ষু মুছাইয়া বলিল, “হেম, আমাকে ক্ষমা কর। তুমি ধর্মপরায়ণ, তুমি পতিব্রতা, আমি যে মুহূর্তের জন্যও তোমাকে সন্দেহ করিয়াছিলাম, সেজন্য ক্ষমা কর।”

 হেম: দিদি, তুমি ক্ষমা চাহিও না, তোমাব দয়া, তোমার ভালবাসা, তোমার ঋণ আমি ইহজন্মে পবিশোধ করিতে পারিব না। জন্মে জন্মে যেন তোমার ভগিনী হই, আর আমার কিছু প্রার্থনা নাই।

 আবার দুইজনে দুইজনকে ধরিয়া ক্ষণেক নিস্তব্ধ হইয়া রহিল, দুইজনের চক্ষু দিয়া জল পড়িতেছিল। পরে শৈবলিনী বলিল, “রাত্রি হইতেছে, যাও, নরেন্দ্রের সহিত দেখা করিয়া আইস।”

 শৈবলিনী সেই বৃক্ষতলে অপেক্ষা করিতে লাগিল, হেমলতা মন্দিরে প্রবেশ করিল। হেমলতার এক্ষণে উদ্বেগ নাই, ধীরে ধীরে নরেন্দ্রেব নিকট আসিয়া দাঁড়াইল ও নম্রভাবে মৃত্তিকার দিকে চাহিয়া রহিল।

 এতদিনের পর হৃদয়ের হেমকে পাইয়া নরেন্দ্রের হৃদয় উদ্বেগপূর্ণ হইল। নরেন্দ্র কথা কহিতে পারিলেন না, কেবলমাত্র হেমের হাত ধরিয়া পিপাসিতের ন্যায় সেই অমৃতমাখা মুখখানি দেখিতে লাগিলেন, শরীর কঁপিতে লাগিল। হেম আর সহ্য করিতে পারিল না, মস্তক নত করিয়া রহিল। তাহার নয়ন ছলছল করিতেছিল।

 অনেকক্ষণ পর হেমলতা নরেন্দ্রের দিকে স্থিরদৃষ্টি করিয়া বলিল “নরেন্দ্র।”

 নরেন্দ্র দেখিলেন, হেমের মুখে আর উদ্বেগের চিহ্ন নাই, লজ্জার চিহ্ন নাই, মুখমণ্ডল নির্মল ও পরিষ্কার। ধীরে ধীরে হেমলতা বলিল, “নরেন্দ্র”!

চৌত্রিশ

 দেবালয়ের সমস্ত দীপ তখন নির্বাণ হইয়াছে ও সমস্ত লোক সুপ্ত অথবা চলিয়া গিয়াছে। স্তম্ভ ও প্রকোষ্ঠের উপর সুন্দর চন্দ্রালোক পতিত হইয়াছে ও সারি সারি

৯৯