পাতা:মানিক গ্রন্থাবলী.pdf/১১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী

করিয়া থাকে। শঙ্কর বলে, যাই মাসিমা—

 আহা বেচারীর মুখখান ম্লান হইয়া গিয়াছে।

 শ্যামা রাগিয়া বলে — ছি খোকা ছি, একি ছোটমন তোর, একি ছোটলোকের মতো ব্যবহার? যা তুই আমার সামনে থেকে সরে!— বসো, বাবা তুমি, একটা কথা শুধোই,— দিদি পত্র দিয়েছে? সেখানে ভাল আছে সব? তুমি যাবে না দার্জিলিং স্কুল বন্ধ হলে?

 শ্যামা শঙ্করের সঙ্গে গল্প করে, হাঁটুতে মুখ গুঁজিয়া বিধান বসিয়া থাকে, কি ভয়ানক কথা ছেলেকে সে বলিয়াছে শ্যামার তা খেয়ালও থাকে না। তারপর বিধান হঠাৎ কাঁদিয়া ছুটিয়া দোতলায় চলিয়া যায়। লাজুক শঙ্কর বিব্রত হইয়া বলে — কেন বকলেন ওকে? — বলিয়া উসখুস করিতে থাকে।

 তারপর সে-ও উপরে যায়। খানিক পরে শ্যামা গিয়া দেখিয়া আসে, দুজনে গল্প করিতেছে।

 সেই যে তাহদের ভাব হইয়াছিল, তারপর শঙ্কর প্রায়ই আসিত। শঙ্করের ক্যারমবোর্ডটি পড়িয়া থাকিত এ বাড়িতেই, উপরে খোলা ছাদে বসিয়া সারা বিকাল তাহারা ক্যারাম খেলিত। বন্ধে তাহার সহিত বিধানের দাজিলিং যাওয়ার কথাটা শঙ্করই তুলিয়াছিল, বিষ্ণুপ্রিয়া ইহা পছন্দ করিবে না জানিয়াও শ্যামা আপত্তি করে নাই, তেমন আদর যত্ন বিধান না হয় না-ই পাইবে, সেখানে অতিথি ছেলেটিকে পেট ভরিয়া খাইতে তো বিষ্ণুপ্রিয়া দিবেই? কিন্তু রাজী হইল না বিধান। একসঙ্গে দাৰ্জিলিং গিয়া থাকার কত লোভনীয় চিত্রই যে শঙ্কর তার সামনে আঁকিয়া ধরিল, বিধানকে বাঁকানো গেল না। যথাসময়ে শঙ্কর চলিয়া গেল সেই শীতল পাহাড়ী দেশে, এখানে বিধানের দেহ গরমে ঘামাচিতে ভরিয়া গেল!

 মনে মনে শ্যামা বড় কষ্ট পাইল। অভাব অনটনের অভিজ্ঞতা জীবনে তাহার পুরানো হইয়া আসিয়াছে, এমন দিনও তো গিয়াছে যখন সে ভাল করিয়া দেহের লজ্জাও আবরণ করিতে পারে নাই, কিন্তু আজ পর্যন্ত চারটি সন্তানের কোনো বড় সাধ শ্যামা অপূর্ণ রাখে নাই,— আকাশের চাঁদ চাহিবার সাধ নয়, শ্যামার ছেলে মেয়ে অসম্ভব আশা রাখে না; শ্যামার মতো গরীবের পক্ষে পূরণ করা হয়তো কিছু কঠিন এমনি সব সাধারণ শখ, সাধারণ আব্দার। বিধান একবার সাহেবের পোশাক চাহিয়াছিল, তাদের ক্লাশের পাঁচ-ছটি ছেলে যে রকম বেশ

১১৭