পাতা:মানিক গ্রন্থাবলী.pdf/১১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী

রকম তরকারি লইয়া আসিয়াছে। বিধান তখন দোকানে গিয়াছিল, হাতের কাজ ফেলিয়া রাখিয়া শ্যামা শঙ্করের সঙ্গে আলাপ করিল। বকুল নামিয়া আসিল নীচে, মা’র গা ঘেঁসিয়া বসিয়া বড় বড় চোখ মেলিয়া সে সবিস্ময়ে শঙ্করের দাজিলিং বেড়ানোর গল্প শুনিল। শুধু বিধানকে নয়, শঙ্কর বকুলকেও ভালবাসে। কেবল সে বড় লাজুক বলিয়া বিধানের কাছে যেমন বকুলের কাছে তেমনি ভালবাসা কোথায় লুকাইবে ভাবিয়া পায় না। পকেটে ভরিয়া সে কি শ্যামার জন্য শুধু তরকারিই আনিয়াছে? মুখ লাল করিয়া বকুলের জিনিসও সে বাহির করিয়া দেয়। কে জানিত দাৰ্জিলিং গিয়া বকুলের কথা সে মনে রাখিবে?

 শ্যামা বড়ই খুশী হয়। সোনার ছেলে, মাণিক ছেলে। কি মিষ্টি স্বভাব? আম কাটিয়া শ্যামা তাহাকে খাইতে দেয়, তারপর রঙীন স্ফটিকের মালা গলায় দিয়া বকুল গল গল করিয়া কথা বলিতে আরম্ভ করিয়াছে দেখিয়া হাসিমুখে কাজ করিতে যায়, পাঁচ মিনিট পরে দেখিতে পায় দুজনে দোতলায় গিয়াছে। রানীকে শোনাইয়া শ্যামা বলে, বড় ভাল ছেলে রানী, একটু অহঙ্কার নেই।... তারপর দোতলায় দুমদাম করিয়া ওদের ছুটাছুটির শব্দ ওঠে, বকুলের অজস্র হাসি ঝরনার মতো নিচে ঝরিয়া পড়ে, এ ওর পিছনে ছুটিতে ছুটিতে একবার তাহারা একতলাটা পাক দিয়া যায়, দুরন্ত মেয়েটার পাল্লায় পড়িয়া লাজুক শঙ্করও যেন দুরন্ত হইয়া উঠিয়াছে।

 পরদিন বিধান স্কুলে চলিয়া গেল শ্যামা বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে দেখা করিতে গেল। দাসী তখন স্নানের আগে বিষ্ণুপ্রিয়ার চুলে গন্ধ-তেল দিতেছিল, চওড়া পাড় কোমল শাড়িখানি লুটাইয়া বিষ্ণুপ্রিয়া আনমনে বসিয়াছিল শ্বেতপাথরের মেঝেতে, কে বলিবে সে-ও জননী। এত বয়সে ওর ঢঙ দেখিয়া মনে মনে শ্যামার হাসি আসে। প্রথম কন্যার জন্মের পর ও আবার সন্ন্যাসিনী সাজিয়াছিল। আজ প্রতিদিন তিনটি দাসী মিলিয়া ওই স্থুল দেহটাকে ঘষিয়া মজিয়া ঝকৃঝকে করিবার চেষ্টায় হয়রান হয়। গালে রঙটঙ দেয় নাকি বিষ্ণুপ্রিয়া?

 বিষ্ণুপ্রিয়া বলিল − বসো।

 শ্যামা মেঝেতেই বসিয়া বলিল — কবে ফিরলেন দিদি? দিব্যি সেরেছে শরীর, রাজরানীর মতে রূপ করে এসেছেন, রঙ যেন আপনার দিদি ফেটে পড়ছে।... অসুখ শরীর নিয়ে হাওয়া বদলাতে গেলেন, আমরা এদিকে ভেবে মরি কবে দিদি আসবেন, খবর পেয়ে ছুটে এসেছি।

১১৯