পাতা:মানিক গ্রন্থাবলী.pdf/২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী

নাই। যে ক'দিন ছেলে বাঁচিয়াছিল আনন্দ ও ভয় উপভোগ করিয়াছিল শ্যামা একা। পাড়ায় শ্যামার সখী কেহ ছিল না। ছেলে হওয়ার খবর পাইয়া কয়েক বাড়ির কৌতুহলী মেয়েরা একবার দেখিয়া গিয়াছিল এই পর্যন্ত। শ্যামা মন খুলিয়া কথা বলিতে পারে, এমন কেহ আসে নাই। একজন, যে কখনো এ বাড়িতে পা দেয় নাই, শ্যামার সঙ্গে ভাব করিতে চাহিয়াছিল। সে পাড়ার মহিম তালুকদারের স্ত্রী বিষ্ণুপ্রিয়া। পাড়ায় মহিম তালুকদারের চেয়ে বড়লোক কেহ ছিল না। ভাব করা দূরে থাক শ্যামাকে দেখিতে আসাটাই বিষ্ণুপ্রিয়ার পক্ষে এমন অসাধারণ ব্যাপার যে শ্যামা শুধু বিনয় করিয়াছিল, ভাব করিতে পারে নাই।

 তখন শীতল ছাপাখানায় গিয়াছে, মন্দা রান্না শেষ করিয়া শ্যামার ছেলেকে স্নান করানোর আয়োজন করিতেছে। কে জানিত এমন অসময়ে বিষ্ণুপ্রিয়া বেড়াইতে আসিবে গয়না-পরা দাসীকে সঙ্গে করিয়া?

 শ্যামা বলিয়াছিল — ও ঠাকুরঝি, ওঘর থেকে কার্পেটের আসনটা এনে বসতে দাও।

 মন্দা বলিয়াছিল — কার্পেটের আসন তো বাইরে নেই বৌ, তোরঙ্গে তোলা আছে।

 মন্দার বুদ্ধির অভাবে শ্যামা ক্ষুন্ন হইয়াছিল। একটা তুচ্ছ কার্পেটের আসন তাও যে তাহারা তোরঙ্গে তুলিয়া রাখে বিষ্ণুপ্রিয়াকে এ কথাটা কি না শোনাইলেই চলিত না!

 — খুলে আন না?

 — দাদা চাবি নিয়ে ছাপাখানায় চলে গেছে বৌ।

 অগত্যা একটা মাদুর পাতিয়াই বিষ্ণুপ্রিয়াকে বসিতে দিতে হইয়াছিল। মাদুরে বসিতে বিষ্ণুপ্রিয়ার কোনই অসুবিধা হয় নাই, কেবল শ্যামার মনের মধ্যে এই কথাটা খচ খচ করিয়া বিঁধিয়াছিল যে, এত বড়লোকের বৌ যদি বা বাড়ি আসিল, তাহাকে বসিতে দিতে হইল ছেঁড়া মাদুরে।

 — গরম জল কি হবে ঠাকুরঝি? — বিষ্ণুপ্রিয়া জিজ্ঞাসা করিয়াছিল।

 — ছেলেকে নাওয়াবো।

 — নাওয়ান, দেখি বসে বসে।

 — মন্দা হাসিয়া বলিয়াছিল — দেখাও হবে শেখাও হবে, না? আপনার দিনওতো

৩৩