পাতা:মানিক গ্রন্থাবলী.pdf/৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

হয়ত শেষ হত। জীবনের চাপে নুয়ে চলা মামুলি লোকের ভীড়। প্রেসের কর্মচারী শীতল, গ্রাম্য জোতদার রাখাল, গর্বিত ধনীগৃহিণী বিষ্ণুপ্রিয়া, বাড়ি পালানো আধপাগলা মামা, নব্বুই টাকার গম্ভীর কেরানী বিধান, মেরুদণ্ডহীন ফেরিওয়ালা বনবিহারী। এত তুচ্ছ যে, চোখে পড়ে না! দূর থেকে এরা শ্রেণীর ভীড়ে একাকার - কারও নাক-মুখের আদল চোখে পড়ে না। ব্যক্তিকে চিনতে হলে কাছে আসতে হয়। শ্রেণী পরিচয়ের ভারী পর্দা সরিয়ে মনের গহনে ঢোকার পথ জানা চাই। গুণে মানুষ ভাবমাত্র। পরিপাটি সজ্জাটি নিখুঁত। পাপে বিকারে ব্যাধিতে প্রসাধনে চিড় ধরে, সাজ ভাঁজ কিঞ্চিৎ বিচলিত হয়। দোষে মানুষ ব্যক্তি। জননীর বহু মানুষের ভীড়ে আমরা হারিয়ে যাই না, কারণ মনের কোণের গোপন ছিটে-ফোটা অশুচি ভাবনায় এরা এক একটি স্বতন্ত্র মুখশ্রী। গ্রীক ট্র্যাজেডিতে বাঁধা মুখোস অভিনয় চলত। জীবন ট্র্যাজেডিতে যত কোটি মানুষ তত কোটি মুখোস। কারুর চামড়ার সঙ্গে তা জুড়ে গেছে। কেউ অতৃপ্ত কেউ অশান্ত। খসে পড়ছে কারুর নির্মোক।

 শীতলের পলায়নপর উচ্ছৃঙ্খলতা, অসামর্থ্যজাত ক্রোধ, পিতৃত্বের তির্যক অভিব্যক্তি, পত্নীকে পীড়নের উদ্দেশ্যে নির্মম আত্মপীড়নের উন্মত্ততা। রাখালের দ্বিপত্নীত্ব, মন্দার সপত্নী প্রীতির আত্মতুষ্টি। পুত্রশোকে শ্যামা কিভাবে কাঁদে বিষ্ণুপ্রিয়ার তাই দেখতে আসা, যৌবনে যোগিনী হওয়া এবং প্রৌঢ়ত্বে নর্মসজ্জা। শামুর প্রতি বকুলের বক্রদৃষ্টি, মেরুদণ্ডহীন বনুবাবুর নীরব প্রেম বা পূজা, বিভার সরব সপ্রীতভ ভর্ৎসনা। অনাচারী মামা এবং রুক্ষ দয়ার্দ্র হারাণ ডাক্তার। সাধারণ প্রতিটি মানুষই প্রায় অসামান্য। আর তারা স্বতন্ত্র হয়েও সংলগ্ন শ্যামার কেন্দ্রে।

 বিধানকে না নিয়ে শঙ্করদের গাড়ি স্কুলে চলে গেলে শ্যামা অপমানিত হয় এবং সাশ্রু নেত্রে অনুরোধ করতে ছোটে। বিরক্ত বিষ্ণুপ্রিয়া না চাইতে কুড়িটা টাকা তার হাতে গুঁজে দিলে সে লাঞ্ছিতা বোধ করে। কিন্তু ভরসার স্বস্তির নিশ্বাসও ফেলে। বাঘিনীর সন্তান রক্ষার উদগ্র জৈব-কামনাই মনুষ্য জগতে বিচিত্র ক্ষুদ্র স্বার্থবোধহীনতা হৃদয়হীনতার সঙ্গে মিলেছে। স্বামীর প্রতি দয়া আছে মোহ নেই, সেবায় সে জননী। কিন্তু হৃদয়ে কদাপি ব্যাকুল নয়। শীতলের জেল হবার মুখে কাতর হয়ে লুকানো হাজার টাকা দিয়ে ফেলেনি। অলস স্বামীর রুগ্নতার ভান ধরে ফেলতে তার কষ্ট হয় নি, ভেঙে দিতে মমতা হয়। এই উপন্যাসের ছোট বড়ো অনেক চরিত্রের মত শ্যামাও ভেঙে অনেকখানা। কিন্তু টুকরোগুলো একত্রে অখণ্ডও।