পাতা:মানিক গ্রন্থাবলী.pdf/৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী

 বিধান কথা বলে না, শুধু কাঁদে।

 সত্যভামা আজও এ বাড়িতে কাজ করে, সে উঠানে বাসন মাজিতেছিল, বলিল — নিজে গলা টিপে মেরে ফেললে মা, এমন দুরন্ত ছেলে জন্মে দেখে নি,— সুন্দোর ছ্যানাটি গো!

 — তুই মেরেছিস? কেন মেরেছিস খোকা? — শ্যামা বারবার জিজ্ঞাসা করিল, বিধান কথা বলিল না, আরও বেশি করিয়া কাঁদিতে লাগিল। শেষে শ্যামা রাগিয়া বলিল — কাঁদিস নে মুখপোড়া ছেলে, নিজে মেরে আবার কান্না কিসের?

 মরা পাখিটাকে সে প্রাচীর ডিঙ্গাইয়া বাহিরে ফেলিয়া দিল।

 রাত্রে শ্যামা শীতলকে ব্যাপারটা বলিল। বলিল, এসব দেখিয়া শুনিয়া তাহার বড় ভাবনা হয়। কেমন যেন মন ছেলেটার, এত মায়া ছিল পাখির বাচ্চাটার উপর! ছেলের এই দুর্বোধ্য কীর্তি লইয়া খানিকক্ষণ আলোচনা করিয়া তাহারা দুজনেই ছেলের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল, বিধান তখন ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। এরকম রহস্যময় প্রকৃতি ছেলেটা পাইল কোথা হইতে? ওর দেহ-মন তাদের দুজনের দেওয়া, তাদের চোখের সামনে হাসিয়া কাঁদিয়া খেলা করিয়া ও বড় হইয়াছে, ওর মধ্যে এই দুর্বোধ্যতা কোথা হইতে আসিল?

 শ্যামা বলে — তোমায় এ্যাদ্দিন বলি নি, মাঝে মাঝে গম্ভীর হয়ে ও কি যেন ভাবে, ডেকে সাড়া পাই নে।

 শীতল গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িয়া বলে — সাধারণ ছেলের মত হয় নি।

 শ্যামা সায় দেয় — কত বাড়ির কত ছেলে তো দেখি, আপন মনে খেলাধুলো করে, খায় দায় ঘুমোয়, এ যে কি ছেলে হয়েছে, কারে সঙ্গে মিল নেই। কী বুদ্ধি দেখেছ?

 শীতল বলে — কাল কি হয়েছে জান, জিজ্ঞেস করেছিলাম, দশ টাকা মণ হলে আড়াই সেরের দাম কত, সঙ্গে সঙ্গে বললে দশ আনা। কতদিন আগে বলে দিয়েছিলাম, যত টাকা মণ আড়াই সের তত আনা, ঠিক মনে রেখেছে।

 বাড়িতে একটা পোষা বিড়াল ছিল, রানী। একদিন দুপুরবেলা গলায় দড়ি বাঁধিয়া জানালার শিকের সঙ্গে ঝুলাইয়া দিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে বিধান তাহার মৃত্যু যন্ত্রণা দেখিতেছিল। দেখিয়া শ্যামা সেদিন ভয়ানক রাগিয়া গেল। রানীকে ছাড়িয়া দিয়া ছেলেকে সে বেদম মাৱ মারিল। বিধানের স্বভাব কিন্তু বদলাইল

৫৭