পাতা:মানিক গ্রন্থাবলী.pdf/৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী

 —আমি এখানে শোব না মা, যা গন্ধ!

 শ্যামা হাসে — তোর বিছানায় বুঝি গন্ধ নেই খোকা? ভারি সাধু হয়েছিস, না?


 বড়দিনের সময় রাখালের সঙ্গে মন্দা কলিকাতায় বেড়াইতে আসিল, পর পর তাহার দুটি মেয়ে হইয়াছে, মেয়ে দুইটিকে সে সঙ্গে আনিল, ছেলেরা রহিল বনগাঁয়ে। মন্দার বড় মেয়েটি একটি খোঁড়া পা লইয়া জন্মিয়াছিল, এখন প্রায় চার বছর বয়স হইয়াছে, কথা বলিতে শেখে নাই, মুখ দিয়া সর্বদা লালা পড়ে। মেয়েটাকে দেখিয়া শ্যামা বড় মমতা বোধ করিল। কত কষ্টই পাইবে জীবনে। এখন অবশ্য মমতা করিয়া সকলেই আহা বলিবে, বড় হইয়া ও যখন সকলের গলগ্রহ হইয়া উঠিবে, ফেলাও চলিবে না, রাখিতেও গা জ্বালা করিবে, লাঞ্ছনা শুরু হইবে তখন। মন্দা মেয়ের নাম রাখিয়াছে শোভা। শুনিলে মনটা কেমন করিয়া ওঠে। এমন মেয়ের ও-রকম নাম রাখা কেন?

 মন্দা বলিল — ওকে ডাকি বাদু বলে।

 শ্যামা ভাবিয়াছিল, সতীন আসিবার পর মন্দার জীবনের সুখ শান্তি নষ্ট হইয়া গিয়াছে, কিন্তু মন্দাকে এতটুকু অসুখী মনে হইল না। সে খুব মোটা হইয়াছে, স্থানে অস্থানে মাংস থলথল করে, চলাফেরা কথাবার্তায় কেমন থিয়েটারি ধরনের গিন্নি-গিন্নি ভাব। স্বভাবে আর তাহার তেমন ঝাঁঝ নাই, সে বেশ অমায়িক ও মিশুক হইয়া উঠিয়াছে। আর বছর মন্দার শাশুড়ী মরিয়াছে, গৃহিণীর পদটা বোধ হয় পাইয়াছে সে-ই, শাশুড়ীর অভাবে ননদদের সে হয়তো আর গ্রাহ্য করে না। রাখালের উপর তাহার অসীম প্রতিপত্তি দেখা গেল। কথা তো বলে না, যেন হুকুম দেয়, আর যা সে বলে, তা-ই রাখাল শোনে।

 — সতীন? হ্যাঁ, সে এখানেই থাকে বৌ, বডড গরীবের মেয়ে, বাপের নেই চালচুলো, এখনে না থেকে আর কোথায় যাবে বল, যাবার জায়গা থাকলে তো যাবে,— বাপ-ব্যাটা ডেকেও জিজ্ঞেস করে না। চামারের হদ্দ সে মানুষটা, ওই করে তো মেয়ে গছালে, ছল করে বাড়ি ডেকে নিয়ে যেত, আজ নেমস্তন্ন, কাল মেয়ের অসুখ,— মন্দা হাসিল, পাড়ার মেয়ে ভাই, ছুঁড়িকে এইটুকু দেখেছি, হ্যাংলার মত ঠিক খাবার সময়টিতে লোকের বাড়ি গিয়ে হাজির হত,— কে জানত বাবা, ও শেষে বড় হয়ে আমারি ঘাড় ভাঙ্গবে!

৬১