পাতা:মানিক গ্রন্থাবলী.pdf/৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মাণিক গ্রন্থাবলী

 মন্দার মেয়ে দুটিকে শ্যামা খুব আদর করিল, আর শ্যামার ছেলেকে আদর করিল মন্দা; রেষারেষি করিয়া পরস্পরের সন্তানদের তাহারা আদর করিল। মন্দার মেয়েদের জন্য শ্যামা আনাইল খেলনা, শ্যামার ছেলেদের মন্দা জামা কিনিয়া দিল। একদিন তাহারা দেখিতে গেল থিয়েটার, টিকিটের দাম দিল মন্দা, গাড়িভাড়া ও পান-লেমনেডের খরচ দিল শ্যামা। দুজনের এবার মনের মিলের অন্ত রহিল না, হাসিগল্পে আমোদ-আহ্লাদে দশ-বারোটা দিন কোথা দিয়া কাটিয়া গেল। মন্দা আসলে লোক মন্দ নয়, শাশুড়ীর অতিরিক্ত শাসনে মেজাজটা আগে কেবল তাহার বিগড়াইয়া থাকিত। শ্যামা জীবনে কারে সঙ্গে এ রকম আত্মীয়তা করার সুযোগ পায় নাই, মন্দার যাওয়ার দিন সে কাঁদিয়া ফেলিল, সারাদিন বাদুকে কোল হইতে নামাইল না, বাদুর লালায় তাহার গা ভিজিয়া গেল। মন্দাও গাড়িতে উঠিল চোখ মুছিতে মুছিতে।

 শুধু রাখালকে এবার শ্যামার ভাল লাগিল না। জেলে না গিয়াও পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার সময় মানুষের কয়েদীর মত স্বভাব হয়, সব সময় একটা গোপন করা ছোটলোকামির আভাস পাওয়া যাইতে থাকে। রাখালেরও যেন তেমনি বিকার আসিয়াছে। যে কয়দিন এখানে ছিল সে, যেন কেমন ভয়ে ভয়ে থাকিত, কেমন একটা অপরাধীর ভাব, লোকে যেন তাহার সম্বন্ধে কি জানিয়া ফেলিয়া মনে মনে তাহাকে অশ্রদ্ধা করিতেছে। সে যেন তাই জ্বালা বোধ করিত, প্রতিবাদ করিতে চাহিত, অথচ সব তাহার নিজেরই কল্পনা বলিয়া চোরের মত, যে চোরকে কেহ চোর বলিয়া জানে না, সব সময় অত্যন্ত হীন একটা লজ্জাবোধ করিয়া সঙ্কুচিত হইয়া থাকিত।

 পরের মাসে শীতল মাহিনা ও কমিশনের টাকা আনিয়া দিল অর্ধেক, প্রথমে সে কিছু স্বীকার করিতে চাহিল না, তারপর কারণটা খুলিয়া বলিল। কমল ঘোষের কাছে শীতল সাতশো টাকা ধার করিয়াছে, সুদ দিতে হইবে না, কিন্তু ছমাসের মধ্যে টাকাটা শোধ করিতে হইবে। সাতশো টাকা! এত টাকা শীতল ধার করিতে গেল কেন?

 — রাখালকে দিয়েছি।

 — ঠাকুরজামাইকে ধার করে সাতশো টাকা দিয়েছ? তোমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে কিনা বুঝি নে বাবু, কেন দিলে?

৬২