পাতা:মানিক গ্রন্থাবলী.pdf/৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী

 শ্যামা বলিল — বলি, দরকার মত বলি। পঁয়ত্রিশ বছ র বয়স হল আজে বাজে কথা আর মুখে আসে না, দোষ বল দোষ, গুণ বল গুণ, যা পারিনে তা পারিই নে।

 ঘর তুলিবার হিড়িকে শ্যামা, আমাদের ছেলে-পাগলা শ্যামা, ছেলেমেয়েদের যেন ভুলিয়া গিয়াছে। কত আর পারে মানুষ? সংসারে উদয়াস্ত খাটিয়া খাটিয়া আগেই তাহার অবসর থাকিত না, এখন মিস্ত্রির কাজ দেখিতে হয়, এটা ওটা আনাইয়া দিতে হয়, ঘর তোলার হাঙ্গামা কি কম! শ্যামা পারেও বটে! এক হাতে ছোট ছেলেটাকে বুকের কাছে ধরিয়া রাখে, সে ঝুলিতে ঝুলিতে প্রাণপণে স্তন চোষে, শ্যামা সেই অবস্থাতে চরকির মতো ঘুরিয়া বেড়ায়, ভাতের হাঁড়ি নামায়, তরকারি চড়ায়, ছাদে গিয়া মিস্ত্রির দেয়াল গাঁথা দেখিয়া আসে, ভাঙা কড়াইয়ে করিয়া চুন নেওয়ার সময় উঠানে এক খাবলা ফেলিয়া দেওয়ার জন্য কুলিকে বকে, শীতলকে আপিসের ও বিধানকে স্কুলের ভাত দেয়, মাসকাবারি কয়লা আসিলে আড়তদারের বিলে নাম সই করে, খরচের হিসাব লেখে, ছোট খোকার কাঁথা কাচে (রানী এ কাজটা করে না, তার বয়স অল্প এবং সে একটু শৌখিন) আবার মামার সঙ্গে, প্রতিবেশী নকুড়বাবুর স্ত্রীর সঙ্গে গল্পও করে। চোখের দিকে তাকাও, বাৎসল্য নাই, স্নেহ মমতা নাই, শ্রান্তি নাই,— কিছুই নাই! শ্যামা সত্যই যন্ত্র নাকি?

 মামা বলে — খেটে খেটে মরবি নাকি শ্যামা? যা যা তুই যা, মিস্ত্রির কাজ আমি দেখব'খন।

 শ্যামা বলে — না মামা, তুমি বুড়ো মানুষ, তোমার কেন এসব ঝঞ্ঝাট পোয়াবে? যা সব বজ্জাত মিস্ত্রি, বজ্জাতি করে মালমসলা নষ্ট করবে, তুমি ওদের সঙ্গে পারবে কেন? তাছাড়া, নিজের চোখে না দেখে আমার স্বস্তি নেই কাজ কতদূর এগুলো, ঘর তোলার সাধ কি আমার আজকের! তুমি ঘরে গিয়ে বোসো মামা, পিঠে কোথায় ব্যথা বলছিলে না? রানী বরং একটু তেল মালিশ করে দিক।

 শীতল কোনো দিকে নজর দেয় না, কেবল সে যে পুরুষ মানুষ এবং বাড়ির কর্তা, এটুকু দেখাইবার জন্য বলা নাই কওয়া নাই মাঝে মাঝে কর্তৃত্ব ফলাইতে যায়। গম্ভীর মুখে বলে — এখানে জানালা হবে বুঝি দেয়ালের যেখানে

৮৫