পাতা:মানিক গ্রন্থাবলী.pdf/৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী

ছেলেকে সে আথালি পাথালি মারিতে আরম্ভ করে।

 বিধান চেঁচায়, বুকু চেচায়, বাড়িতে একেবারে হৈ-চৈ বাধিয়া যায়। শ্যামা দুই হাতে বিধানকে বুকের মধ্যে আড়াল করে, শীতল গায়ের ঝাল ঝাড়িতেই শ্যামার গায়ে দু-চারটা মার বসাইয়া দেয় অথবা সেগুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হইয়া শ্যামার গায়ে লাগে বুঝিবার উপায় থাকে না। শ্যাম তো আজ গৃহিণী, মোটাসোটা রাজরানীর মতো তাহার চেহারা, শীতল কি এখন তাহাকে ইচ্ছা করিয়া মারিবে?


এমনিভাবে দিন যায়, ঠাণ্ডায় শীতের দিনগুলি হ্রস্ব হইয়া আসে। মামা সেই যে একবার শ্যামাকে কুড়িটি টাকা দিয়াছিল আজ পর্যন্ত সে আর একটি পয়সাও আনিয়া দেয় নাই, শ্যামা তবু শীতলের চেয়ে মামাকেই খাতির করে বেশিঃ মামার সঙ্গে শ্যামার বনে, শ্যামার ছেলেদের মামা বড় ভালবাসে, শীতলের চেয়েও বুঝি বেশি। নিজের বাড়িতে শীতল কেমন পরের মতো থাকে, যে সব খাপছাড়া তাহার কাণ্ড, কে তাহার সঙ্গে আত্মীয়তা করিবে? শীতলকে ভালবাসে শুধু বকুল। মেয়েটার মন বড় বিচিত্র, যা কিছু খাপছাড়া, যা কিছু অসাধারণ তাই সে ভালবাসে। শীতলও বোধহয় খোঁড়া কুকুর, লোম-ওঠা ঘা-ওলা বিড়াল, ভাঙ্গা পুতুল এই সবের পর্যায়ে পড়ে, বকুল তাই শ্যামার ভাষায় ‘বাবা বলিতে অজ্ঞান।’

 ছেলেবেলা হইতে বকুলের স্বাস্থ্যটি বড় ভাল, চলাফেরা হাসি খেলা স্বাভাবিক নিয়মে সবই তার সুন্দর, কত প্রাণ, কত ভঙ্গি। সকলে তাহাকে ভালবাসে, তার সঙ্গে কথা বলিতে সকলেই উৎসুক, সে কিন্তু যাকে তাকে ধরা দেয় না, নির্মমভাবে উপেক্ষা করিয়া চলে! খেলনা ও খাবার দিয়া, তোষামোদের কথা বলিয়া তাহাকে জয় করা যায় না। মামা কত চেষ্টা করিয়াছে, পারে নাই। শ্যামার তিন ছেলেই মামার ভক্ত, বকুল কিন্তু তাহার ধারে কাছেও ঘেঁষে না।

 শ্যামার সঙ্গেও বকুলের তেমন ভাব নাই, শ্যামাকে সে স্পষ্টই অবহেলা করে। বাড়িতে সে ভালবাসে শুধু বাবাকে, শীতল যতক্ষণ বাড়ি থাকে, পায়ে পায়ে ঘুরিয়া বেড়ায়, শীতলের চুল তোলে, ঘামাচি মারে, মুখে বিড়ি দিয়া

৮৭