পাতা:মানিক গ্রন্থাবলী.pdf/৯৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মাণিক গ্রন্থাবলী

 জঙ্গলের রূপকটা তাহার অনুভূতি।

 হ্যাঁ, মানুষ বদলায়। বদলায় না বাড়িঘর, বদলায় না জগৎ। এমনি শীতকালে একদিন রাত্রে বরান্দায় শীতলের বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় শীতে তাহাকে কাঁপিতে দেখিয়া রাখাল নিজের গায়ের আলোয়ান গায়ে জড়াইয়া দিয়াছিল, হাত ধরিয়া ঘরে লইয়া বলিয়ছিল, বৌঠান তুমি শোও, আমি দরজা খুলে দেব।... শ্যামার সব মনে আছে, সে সব ভুলিবার কথা নয়। রাখাল তাকে যেন দামী পুতুল মনে করিত, এতটুকু আঘাত লাগিলে সে যেন ভাঙিয়া যাইবে এমনি যত্ন ছিল রাখালের। অসুখ হইলে কপালে হাত বুলানোর আর তো কেহ ছিল না তাহার রাখাল ছাড়া!

 টাকার কথাটা দুপুরে উঠিয়া পড়িল, রাখাল মাথা নিচু করিয়া বলিল, জান তো বৌঠান আমার রোজকার? পঁচানব্বই টাকা মাইনে পাই, দুটো সংসার ছেলেমেয়ে, কোনো মাসে ধার হয়। একটা বোনের বিয়ে দিয়েছি, এখনও একটা বাকি, তারও বয়স হল। দু-এক বছরের মধ্যে তার বিয়ে না দিলেও চলবে না,— এখন কি করে তোমার টাকা দিই বৌঠান?— তোমার অবস্থা বুঝি, আমার অবস্থা বুঝে দেখো।

 সুতরাং তাহদের কলহ বাধিয়া গেল খানিক পরেই। এমন শীতের দিনে জলে হাত ভিজাইয়া ঠাণ্ডা করিয়া হঠাৎ পরস্পরের গায়ে দিয়া একদিন তাহারা হাসাহসি করিত, টাকার জন্য তাহদের কলহ? একি আশ্চর্য কথা যে সেদিনের স্মৃতি তাহারা ভুলিয়া গেল, সংসারে রূঢ় বাস্তবতার মধ্যে যে ইতিহাস স্মরণ করা মাত্র দুদিন আগেও যাহারা অবাস্তব স্বপ্ন দেখিতে পারিত? শ্যামা কড়া কড়া অপমানজনক কথা বলিল, সেই সাত শত টাকার উল্লেখ করিয়া রাখালকে সে একরকম জুয়াচোর প্রতিপন্ন করিয়া দিল। রাখাল জবাবে বলিল, শ্যামা যদি মনে করিয়া থাকে নিজের হকের ধন ছাড়া শীতলের কাছে কোনো দিন সে একটি পয়সা নিয়াছে, শীতল জেল হইতে ফিরিলে শ্যামা যেন আর একবার তাকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখে। শ্যামা বলিল, হকের ধন কিসে? রাখাল বলিল, শ্যামা তার কি জানিবে? মন্দার বিবাহ দিবার সময় শীতল যে জুয়াচুরি করিয়াছিল, রাখাল বলিয়াই সেদিন তাহার জাত বাঁচাইয়াছিল, আর কেহ হইলে বিবাহসভা হইতে উঠিয়া যাইত। শীতল অর্ধেক গয়না দেয় নাই, পণের টাকা দেয় নাই একটি পয়সা। তারপর সেই গোড়ার দিকে প্রেসের কি সব কিনিবার জন্য ভুলাইয়া সে যে রাখালের

১০০