পাতা:মানিক গ্রন্থাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড).pdf/৫৭১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিস্থিতি 2. সোয়ারি লইয়া ফিরিয়া দু’আনায় কেনা রুটি দু’খানি বিনা পয়সায় পাওয়া ছোলার ডাল ও ছ্যাচরাটুকু দিয়া খাইবে। সামনের মিষ্টির দোকানে তাকে ছ’আনার দুধ মিষ্টি খাওয়াইতে আমাকে যেরকম ধন্তাধস্তি করিতে হইয়াছিল, ইঞ্জিনে কয়লা দিতে কি ড্রাইভারের সেরকম হাঙ্গামা ও পরিশ্রম করিতে হয় ? বেচারার করুণ দৃষ্টি দেখিয়া মনে হইয়াছিল আমাকে পুলিশেরও অধম ভাবিতেছে। আমি দাম দিলে অবশ্য সে খুশি হইয়া খাইত। কিন্তু আমি ইচ্ছা করিয়া দিই নাই। কেবল চুক্তির ভাডাটা চুকাইয়া দিয়া বাকী পথটা হাঁটিয়া গিয়াছিলাম। আজকাল অভিযোগ শুনিতে পাই রিক্সাওয়ালাদের পায়া ভারি হইয়াছে। সোলজারগুলোকে ঠকিয়ে মোটা পয়সা পায় আমরা ডাকলে কথাই বলতে চায় না । স্পষ্ট মুখের ওপর বলে বসে মশায়, যাব না । অনুযোগে যে পরিমাণ জ্বালা প্ৰকাশ পায়, কোনো রিক্সাওয়ালা সেই অনুপাতে তেজ দেখাইয়া কোনো ভদ্রলোককে অপমান করিয়াছে বিশ্বাস করতে পারিলে খুশি হইতাম। খুব খানিকটা খাতির আর সম্মান দেখায় নাই, সত্য বোধ হয়। শুধু এইটুকু। ট্যাক্সিওয়ালার হুমকি আর ঘোডার গাড়ির গাডোয়ানের টিটকারিতে বাবুদের বেশি লাগে না। কিন্তু রিক্সাওয়ালা জাতটাই নিরীহ গোবেচারী ভীরু । তাদের দেহ কাবু হয় জঘন্য শ্ৰাস্তিতে যা প্ৰায় ক্ষয়রোগ ও ইস্পানি রোগের সমবেত "আক্রমণের মত ; মৃদু এবং শ্লথ কিন্তু দুনিবার। মন কাবু হয় আত্ম-তুচ্ছতার কঠিন রোগে । সবাই গাল দেয়, হুমকি দেয়, ধমকায় । সবাই অন্যায় করে, অবিচার করে, অত্যাচার করে। সুস্থ সবল তেজস্বী মানুষ কয়েকবছর রিক্স টানিবার পর জীৰ্ণ শীর্ণ হইয়া ঝিমায়, বিশ্বাস করে যে রিক্স টানাটাই চুরি করা বা ভিক্ষা করার মত হেয় কাজ। লোকে যে রিক্স। চাপিয়া পয়সা দেয় সেটা শুধু অনুগ্রহ করা নয়, উদারতার পরিচয় ও বটে – রিক্স টানার অপরাধ ক্ষমা করার উদারতা। অস্পৃশ্যর কঠিন নোংরা কাজ করিয়া টিকিয়া থাকার সুযোগ পাওয়ার মধ্যে জাতওলাদের যে উদারতা দেখিয়া কৃতজ্ঞতায় কৃতাৰ্থ বোধ করে। নিরীহতম দু’একটি কেঁচো হয় তো যুদ্ধের অস্বাভাবিক অবস্থার চাপে নিরীহ হেলে সাপ সাজিয়াছে, তাতেই চোখ কপালে উঠিয়া গিয়াছে অনেকের । ছদ্মবেশী বিষাক্ত সাপগুলি যে কিলবিল করিতেছে চারিদিকে তাতে কোনো আপসোস নাই। এই নিপীড়িত ক্ষয়িষ্ণু মানুষগুলির সহজ সৌজন্য আমাকে মুগ্ধ করে। ভয় বা খাতিরের বিনয় নয়, বকশিসের লোভের খোসামোদ নয়, খাটি সৌজন্য। অন্যের