পাতা:মানিক গ্রন্থাবলী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৪৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বাস দাওয়ায় উঠে শোয়, কেউ টের পায় না। লেজ নাড়তে নাড়তে কখনো কাছে এলে গোবর্ধন তাকে দূরদূর করে ভাগিয়েই দিয়েছে চিরদিন। তবু আজি কালোর পরাজয়ে কেমন একটা অপমান বোধ ভেতরে কামড়াতে থাকে। গজেনের লোম ওঠা বুড়ো কুকুরের কাছে তার চিকন কালো কুকুর হেরে গেল! তারপর আর তো ঘুম আসে না গোবধানের । জীবনের সমস্ত সঞ্চিত ক্ষোভ আর নালিশ যেন একসঙ্গে পাক দিয়ে উঠে তার কণ্ঠ রোধ করে দিতে চায়। সেও প্ৰায় জগতের ছোট-বড় আপন-পর সকলের জিদের কাছে এতকাল হার মেনেছে, তার ইচ্ছা অনিচ্ছাকে কুঁকড়ে দিয়েছে সবাই মিলে। অপরাজেয় বিরাট দৈত্যের মতো একটা অদৃশ্য শত্রুর সান্নিধ্য গোবর্ধন স্পষ্ট অনুভব করে। এদিকে ততক্ষণে শুরু হয়েছে ওষুধের দোকানে মানুষের লড়াই। দণ্ডধারী ও শ্ৰীমন্ত্যসহায়ের দৈনন্দিন কথা - কাটাকাটি আজ প্ৰচণ্ড কলহে পরিণত হয়েছে। শ্ৰীমন্তসহায় চিরদিন কড়া কথাও আস্তে বলে, গলা চড়ায় না । গলা ছেড়ে আজি সে মামাকে গাল দিচ্ছে শুনে গোবধােন আশ্চর্য হয়ে গেল । তারপর যে কাণ্ড করল শ্ৰীমন্তসহায়, দেখে শুনে তাক লেগে গেল গোবধানের। গর্জন করতে করতে দণ্ডধারীকে টেনে হিচড়ে দোকানের বাইরে এনে সজোরে এক ধাক্কা দিল । দণ্ডধারী একেবারে আছড়ে পড়ল বাধান পাথুরে রাস্তার ধুলোয়। আলো নিভিয়ে দোকানের দরজা বন্ধ করতে করতে শ্ৰীমন্ত সহায় বলল, “আর ঢুকো না মোর দোকানে তুমি। যেখানে খুশি ডাক্তারী করে বড়লোক হওগে যাও । একটি পয়সা ভাগ চাইব না।” দণ্ডধারী তখনও রাস্তা ছেড়ে উঠে দাড়ায় নি। সামনে পা ছড়িয়ে এপাশে রাস্তায় দু'হাতে ভর দিয়ে পিছনে হেলে সে বোধ হয় রাগ আর ব্যথা সামলে নিচ্ছিল। ক্রুদ্ধ আৰ্তনাদের মতো উদ্ভট সুরে সে জবাব দিল, 'মারলি! গুরুজনকে মারলি ! সর্বনাশ হবে তোর, ঘরে তোর মড়ক লাগবে। তখন যদি পায়ে ধরে এসে কঁদিস, মাথা কপাল কুটিস চিকিচ্ছের জন্তে-তুই মরবি, মা ছেতলার কিরূপ হয়ে একুশ দিন ভুগে মরবি।” এতক্ষণে সকলে এসে ঘিরে দাড়িয়েছে । পুবে সদ্যোদিত মান নিম্প্রভ চাদের আবছা আলোয় দণ্ডধারীকে রাস্তায় পড়ে তীক্ষ্ণ চড়া কান্নার সুরে অভিশাপ দিতে শুনে দুচারজনে শিউরে উঠল। এ বছর চারিদিকে বেশ ভালো করেই বসন্ত রোগের আবির্ভাব ঘটেছিল, এখন একটু নরম পড়েছে। দণ্ডধারীর অভিশাপ 36