২
বৃহত্তর—মহত্তর
রাগের মাথায় একটা বেফাঁস কথা বার হয়ে গেছে বলে কি এমন করতে হয় রে দাদা! মাইরি আমার বুক কাঁপছে এখনো।
কাঁপুক। চট্ ক’রে বলুন দিদির কি হয়েছে।
সে অনেকক্ষণ ধরে যা বললে তার সংক্ষিপ্ত মর্ম এই। মাস চারেক আগে একদিন সকালে উঠেই মমতাদি বললে, আমি বিদায় হলাম। এ জীবনের ক্ষুদ্রতা আমার সইচে না। আমি মহত্তর বৃহত্তর জীবনে সার্থকতা খুঁজতে চললাম। ব’লে নগেনকে কথাটি কাইবার (অর্থাৎ চুলের মুঠি ধরে আটকাবার) সুযোগ না দিয়েই ফস্ করে চলে গেল। নগেন প্রথমটা ভেবেছিল সে বুঝি আমায় ভর করেই অকূলে ভাসল। (এইখানে সে হাত জোড় করলে, পাছে আমি রাগ করি।) শেষে শুনল, তা নয়, কি একটা নারী-সমিতিতে যোগ দিয়ে সে দেশের কাজে লেগেছে। চরকা ঘোরায়, ছোট ছেলেমেয়েদের পড়ায়, বাড়ি বাড়ি মেয়েদের কাছে স্বদেশী প্রচার করে। একথা জেনে আমাকে মিথ্যা সন্দেহ করার জন্য দুঃখে লজ্জায় অনুতাপে———
আমি চুপ করে বসে রইলাম, সে আমার কানের কাছে দুঃখ লজ্জা অনুতাপের জলন্ত বর্ণনা করে চলল। আমি খানিক শুনলাম, খানিক শুনলাম না। শেষটা কিছুই শুনলাম না।
উদ্গারের শব্দে সচেতন হয়ে দেখলাম, তার খাওয়া ও বক্তৃতা শেষ হয়েছে। পুনরায় উদ্গার তুলে বললে, আর খাব না, দামটা দিয়ে দিন।
দিচ্ছি। এত ঘটা ক’রে সাজ করেছেন কেন বলুন ত? দিদির শোকে নাকি?
কালো দাত বার করে সে হাসল, আরে রামো, সে বৃহত্তর মহত্তর জীবনে সার্থক হতে গেছে, তার জন্যে শোক কি! আবার বিয়ে করে ফেলেছি কিনা———বুঝলেন না? দুটো পয়সা দিন ত, পান কিনব।
আমার হঠাৎ ইচ্ছা হল খাবারের দাম না দিয়ে চলে যাই; দোকানীর হাতের অনেক মিষ্টি খেয়েছে, একটু প্রহারও থাক। কষ্টে সে সঙ্গত ইচ্ছা সংযত করে দাম মিটিয়ে দিলাম। পান খাবার পয়সা দিয়ে নারী-সমিতির নাম টুকে নিয়ে পথে নেমে গেলাম। পথে মানুষের ভিড়। আমার মনে হল, একই পথ বেয়ে আমিও চলেছি এত লোকও চলেছে, কিন্তু প্রত্যেকের মনোবেদনার উৎস কত বিভিন্ন! এতগুলি চিন্তা-জগতের একটিতেও কি মমতাদির মত কেউ নীরব দুঃখের পদচিহ্ন এঁকে চলেছে?
● মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ●