পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র অষ্টম খণ্ড.pdf/১০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ইতিকথার পরের কথা O ভূদেব, করুণাময়ী এবং কয়েকজন বন্ধু এবং বান্ধবীদের সাথে মায়া সেদিন কাবখানা দেখতে এল। ভিতরে লক্ষ্মীর সঙ্গে কথায় শুভ মশগুল । মায়াদের আবির্ভাবজ্ঞাপক শ্লিপটি দারোয়ানেব কাছ থেকে যথারীতি বঁ হাতে নিয়ে না পড়েই শুভ সুকুম দেয়, ঠাহবনে বোলো। লক্ষ্মী সেদিন একটা ছাপা শাড়ি পরে এসেছিল। সস্তায় ছাপা সস্তা শাড়ি। রোজ কারখানায় যেতে হবে, চাকরি করছে, কৈলাসকে সে কলকাতা থেকে একটা শাড়ি কিনে আনতে দিয়েছিলকলকাতায় নাকি সস্তায় ভালো শাড়ি মেলে। কী যে বুচ। আর পছন্দ কৈলাসেব, এনে দিয়েছে এই ছাপা শাড়িটা। নিজেব পকেট থেকে কিছু দিয়েছিল। কিনা কে জানে ! গজেন দেখে বলেছিল, বাঃ, খাসা কাপড়টা। কিন্তু তার পছন্দ হয়নি, সে শিউরে উঠেছিল। লজ্জায়। কাপড়টা সাত-আটদিন লক্ষ্মী পারেনি। সাবান কাচা মোটা খাটাে শাড়ি পরেই কাবখানায় এসেছে গিয়েছে। কী ভারী শাড়ি ! ধুলে এক পরলে ছাড়া নিঙরানো যায় না। অমন শক্ত মোটা শাড়িটাও ফেসে গেছে। সে জন্যই বোধ হয় তেমন লজ্জাও করছে না। তার। এই শাড়িখানা তার পরনে না দেখলে হয়তো রাম সিং দারোয়ান মায়ার সই করা চিরকুট দেখার সময় একটু বিশদ করে জানােত কী ধরনের কেমন লোকেরা ফটকের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। শুনে শুভও হয়তো সচেতন হত। কিন্তু এ রকম একটা শাড়ি পরা মেয়ের সঙ্গে বাবুকে এমন আত্মহাবা হয়ে কথা বলতে দেখে তাকে কিছু বলার সাহস রাম সিং খুঁজে পেল না। নিয়ম সম্পর্কে শূভ ভারী কড়া। সুখনােদর সম্পর্কে মনে মনে তার একটু আশঙ্কাও ছিল। তাই গেট পাশ বা কুকুম ছাড়া কারও কারখানায় ঢোকা বিশেষভাবে নিষিদ্ধ ছিল। শূভর কারখানার গেটের সামনে মায়াদের তাই অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অনেকক্ষণ মানে মিনিট দশেক। বাগ চড়তে চড়তে মায়া পৌঁছে যায় টং হবার অবস্কায । এই ! বাবু ভিতরমে হ্যায় ? জুজুর। হাম ভিতর চলতা। হুকুম নেহি সুজুর। চোপরাও ! সুকুম নেহি ! মায়া গাঁটগট করে ভিতরে ঢুকে যায়। বাসন নিয়েই লক্ষ্মীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল শুভব। নতুবা এতটা সে মশগুল হযে পড়ত না। গরিবের মেয়ে একটু তেজি আর সপ্ৰতিভ হলেহ সিনেমায় তার জন্য জমিদারের ছেলের ভীষণ টান জন্মায়, দেশি বাংলা সিনেমা দু-চারটির বেশি দেখেনি বলেই বোধ হয় শূভর বেলা সেটা ঘটেনি। সাধারণ চাষির ঘরে কী ধরনের বাসন সবচেযে বেশি ব্যবহার হয়, বিয়েতে মোটামুটি কী কী বাসন যৌতুক দেওয়া হয়, গরিবের ঘরেও মেযেরা যে ঝকঝকে করে মাজার জন্য ঘষে ঘষে দামি বাসনও ক্ষয় করে ফেলে এই বেহিসেবি ব্যাপারের আসল মানেটা কী, এই সব নানাকথা সে খুঁটিয়ে জেনে নিচ্ছিল। শহুরে আব্ব গ্ৰাম্য বাসনে তফাৎ আছে কিনা। আর থাকলে সেটা কী রকম তফাত বুঝবার চেষ্টা করতে চাওয়ায় লক্ষ্মী হেসে ফেলে। বাসনের কী শহর আর গা ভেদ আছে ছোটােবাবু ? বাসনের তফাত হল গিয়ে পয়সার তফাত । গরিবের ঘরে সাদামাটা ছোটোখাটো বাসন, বড়োলোকের ঘরে রকমারি দামি দামি বাসন।