পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র অষ্টম খণ্ড.pdf/১০৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

otr মানিক রচনাসমগ্ৰ বেজন্মা, বজাত ! ব্যাটার বউটাকে ঘর ছাড়ালে ! রাজেন বলে, ইন্দ্র ফুসলেছে না ? ফুসলেছে, আমন সবাইকে ফুসলায়। কে কোথা ফুসলায় আর ওমনি ঘর ছাড়ে ঘরের বউ, না কি বটে ? কারও ঘরে মেয়ে-বউ রইত না তালি। খেতে দিত না তো কী করবে। ঘর না। ছেড়ে ? পিনাক বলে, ঠিক কথা, ভাতের ঘাটা নেই। বটুকের। তবু ব্যাটার বউটাকে না খেতে দিয়ে ঘর ছাড়ালে। তামুক ছাড়া জমে না।--আরেকবার আপশোশ করে লোচন। নাতির মরণে সে যেন তেমন কাতর নয়, তামাকের জন্য আপশাশটা বেশি। বিশেষ করে রাজেন দাস আজ যেচে এসে তার দাওয়ায় বসেছে বলে। মাননীয় ব্যক্তির পদার্পণে ধন্য হয়ে তাকে খাতির করার সাধ মেটানো গেল না বলে নয়, যে ছিল। পরম শত্ৰু সে আজ বাড়িতে এসেছে বলে। সাপ-বেজির সম্পর্ক ছিল তাদের অনেককাল। রাজেনের বোন সুখদা ছেলেপিলে নিয়ে আজ সাতবছর ঘর করছে শিয়াপোলের আনস্তের, তাকে ঘনরাম বিয়ে করেনি কথাবার্তা পাকা হবার পব-এই ছিল ঘটনা। ঘাটের পথে সাঁঝের বেলা একলা সুখদাকে নিমাই ছোঁড়ার সাথে কথা কইতে দেখেছিল, হেসে হাত নেড়ে কথা কইতে দেখেছিল ঘনবাম নিজের চোখে-এই ছিল কারণ। কথা সে-ই কইতে গিয়েছিল নিজে, দুটাে মিষ্টি মিষ্টি প্রাণের কথা আর বলা হয়নি প্ৰাণের জ্বালায়। খটকা একটা এমনিই ছিল ঘনরামের মনে যে তার সাথে লুকিয়ে ভােব করতে পারে যে মেয়েটা সে কি আর অন্যের সাথে পারে না ? এ ক্ষেত্রে অবশ্য ভাবটা হয়েছে তারই সাথে, কিন্তু কথা হল, স্বভাব ভালো যে মেয়েব সে তো এ রকম ভাব-সাবের ব্যাপার করে না। কারও সাথেই ! যে খুঁতখুঁতনি মনে ছিল সেটা প্ৰত্যয় হল হেসে হেসে নিমাইয়ের সাথে হাত নেড়ে কথা বলা দেখে বঁাশঝাড় গাছপালায় ঘেরা যে নির্জন স্থানটিতে শুধু তারই সাথে কথা বলার কথা ছিল সুখদার ! ছেলের কথায় বিয়ে তাই ভেঙে দিল লোচন, নিজে যেচে বরণ কবা যন্ত্রণায় ঘনরামও দিশেহারা হয়ে রটিয়েও দিল মেযেটার নামে মনগড়া | ! তারপর ঘটনা রটনা গালাগালি হাতাহাতি পুরানো হয়ে তলিয়ে গেল অতীতে, জিদ বজায় রইল মুখ-দেখাদিখি বন্ধ রাখার, শত্ৰুতা করার। বিয়াল্লিশ সালে দেশজুড়ে ব্যাপার হল একটা। বন্দুক উচিয়ে সৈন্য পুলিশ এসে অন্য কটা ঘরবাড়ির সাথে পুড়িয়ে দিল রাজেনের বাড়ি, আর এমনি মজার যোগাযোগে আদেষ্টের যে, দু-কোশ তফাতে কেঁদা গাঁয়ে লোচনের মামা জগন্নাথের বাড়িতে সপরিবারে আশ্রয় নিয়ে দুটাে রাত কাটাতে হল রাজেনকে সপরিবার লোচনের সাথেই। রাজেন ভেবেছিল, মামাকে বলে ভুষণ তাদের খেদিয়েই দেবে বেহদা মার-ধোর খুন-জখম বলাৎকার ঘর-পোড়ানোর তাণ্ডবের মধ্যে। তা, কথাটা লোচনও ভেবেছিল একবার, এতকালের শত্ৰুকে জব্দ করার এমন খাসা সুযোগ আর আসবে না জীবনে। কিন্তু দুটাে দিন বিপদে পড়ে একসাথে থাকার পর সেই থেকে বিদ্বেষ ঘুচে গেছে তাদের, পথেঘাটে দেখা হলে দুটা-একটা কথা তারা বলে এসেছে পরস্পরে, কিন্তু শুধু ওই শত্ৰুতার অবসান ঘটা ছাড়া বেশি আর এগোয়নি তাদের সম্পর্ক। কেউ পা দেয়নি। কারও বাড়ি, ক্রিয়াকর্মে আপদে-বিপদে কেউ ডাকেনি অন্যকে। এতকাল পরে রাজেন আজ নিজে থেকে এসেছে তার বাড়ি। ওকে দু-টান তামাক না। টানতে দিতে পারলে কেমন লাগে মানুষের ? তিনটে বিড়ি নিয়ে আসে রসিক। তাই একটা রাজেনকে দেয় লোচন, পিদিম থেকে ধরাতে গিয়ে নিবে যায় শিখাটুকু। ফের হাঙ্গামা করতে হয় আপুন সৃষ্টি করার। দু-একটান টেনে বিড়িটা রাজেন বাড়িয়ে দেয় তোরাব আলিকে।