পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র অষ্টম খণ্ড.pdf/১২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SSS মানিক রচনাসমগ্ৰ মোদের মতলবটো ফেঁসে গেল । অ্যান্তে কথা কও ; কেন ? নিজের সুবিধার জন্য ধর্ম পালটানো যায় না। ধর্মটাও দশজনের জিনিস। লক্ষ্মী মুখ তোলে না, বঁটির ফলাটার দিকে তাকিয়ে থেকেই সে বলে, তা হবে না, আমি মন ঠিক করে ফেলেছি। কৈলাস মাথা নাড়ে, সে হয় না। হিসেবে মস্ত ফাকি রয়ে গেছে। আমি চালাক বাবুদের মতো হিসেব কষে বসেছি। থিয়োরিটা খাড়া করেছি। ভিন্ন করে, অবস্থাটা যাচাই করেছি। ভিন্ন করে, দুটাে মেলাইনি। মেলাতে গিয়ে দেখছি, বাবা, এ যে বিষম ফাদ। ধর্ম শিকড় গেড়ে জাকিয়ে রয়েছে দেশে, তুমি আমি বললেই তো বাতিল হবে না। ধর্ম পালটালে নতুন ধর্মকে তুলে ধরতে হবে, গুণগান করতে হবে। মেরা সত্যিসত্যি নিজেদের সুবিধার জন্য ধর্ম পালটাব লোকে যাতে সেটা না ভাবে সে জন্য আরও বেশি করে গলা চড়িয়ে গুণগান করতে হবে। নইলে খেলো হয়ে যাব লোকোব কাছে। ধর্মটর্ম যদি নাই মানি মোরা, ধর্মকে কাজে লাগাতে যাব কোন মুখে ? লোকে ছি ছি করবেই। ধারালো বঁটিতে ভাড়ালি কুটে যায় লক্ষ্মী। কৈলাস বলে, জীবনবাবুর মতোই দশা হবে মোর। শুভর চাকরিটা নিয়ে বেচারাকে মুখ বন্ধ করতে হয়েছে। ধর্ম পালটে তোমায় পেলে মোকে হতে হবে সাম্প্রদায়িক । নাহলে, লোকে জানবে, এ মানুষটা সস্তা সুবিধাবাদী। লক্ষ্মী বলে, তবে থােক। লক্ষ্মী একদিকে পরম স্বস্তি বোধ করে, আবার প্রাণটা তার জুলেও যায কৈলাসের আচবাণে। কৈলাস নিজেই বুঝেছে যে, যেভাবেই হােক নিজের সুখটা বাগিয়ে নেবার উপায। তার নেই। তাতে নিজেরই খাটি সুখে বাদ সাধা হবে-এতে স্বস্তি লক্ষ্মীর। আবার তাকে এমন কবে নাচিয়ে এমন আচমকা কৈলাস পিছিয়ে গেল-এতে তার জ্বালা। মেয়েমানুষ সে রাজি হল, কৈলাসের এত হিসাব কেন, এত ভয় কেন, এত স্পর্ধা কেন ? লক্ষ্মী নিজেই আবার নিজেকে বলে, ধিক মোকে। আমি দেখছি মধুর মারও বাড়া, মরতে বসেও বসেও গেয়োমি যায় না। মধুর মা মারা গেল। এক রকম না খেয়েই—যদিও একটা রোগ হয়ে। খাদ্য পেলে অখাদ্য খেয়ে এ রোগটা মানুষের বরণ করতে হয় না। কিন্তু মরতে মরতে রসিকের মা বলে, কপাল গো, কপাল ! কত জন্মো পাপ করেছি। তাই পেটের ছেলে খেতে দেয় না-বাউ নিয়ে থাকে। তার জ্বালাটা একটু কমাবার জন্যই লক্ষ্মী বলেছিল, তোমার ছেলেও খেতে পাচ্ছে না গো। বউটাকে হাসপাতালে ঢুকিয়েছে অনেক কষ্টে, বাঁচবে। কিনা ঠিক নেই। মধুর মা ক্ষীণস্বরে বলে, হবে না ? হবে না ? ভগোমান নেই ? মাকে না দেখলে বউ মরবে না হাসপাতালে ? মরুক ! মরুক ! বলতে বলতে কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার। মরবার আগে ভগবানের নাম তবু উচ্চারণ করা হয়ে গিয়েছিল ছেলের উপর ঝাল। ঝাড়বার ছলে-কেউ কেউ তাতেই তুষ্ট হয়েছিল। যেভাবে হোক নাম করলেই হল। তার নয় মনের আগুন ও সব বালাই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, সবার তো যায়নি। সবার সাথে থাকতে গেলে গোয়ার তুমিও চলে না। একেবারে কিছুই না মানার। পোড়া সংস্কারের ছাঁইগাদাতেও তাই চারা গজায়, বিশ্বাসের পোড়া ডালে গজায় নতুন পাতা ।