পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র অষ্টম খণ্ড.pdf/১৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ܬܬܬ নন্দার ধারণা ছিল এ সব কাহিনি শুনে সুনীল চমকে যাবে। সুনীল শাস্তভাবে শুধু বলেছিল, এ রকম কত ব্যাপার যে ঘটেছে! অন্য অনেক রকম হিসাব তো আছেই, যুদ্ধের জন্য কত লাখ মেয়ে যে স্বামী হারিয়েছে। গা জুলে গিয়েছিল নন্দাব। ছেলে হারায়নি ? হারিয়েছে। বইকী। ছেলে হারানো মেয়েদের সায়। ছেলেমেয়ে বাইপ্রোডাক্ট তো। স্বামী হারালেই সর্বনাশ। নন্দা খানিকক্ষণ কথা বলতে পারেনি। তার বিয়ে হয়েছিল, সে স্বামীর সংসার করেছে, এ সব শুনে না হয় চমক নাই লাগল সুনীলের, মৃত স্বামীর বুনো মেয়ের সঙ্গে পিরিত করতে গিয়ে প্ৰাণ হারানোর কাহিনি যে সে এমন অনায়াসে শুনিয়ে দিল, এতে একটু আশ্চর্য হওয়া তো উচিত ছিল তার { গলার সুব পালটে সে বলেছিল, মানুষটা খারাপ ছিল ভাববেন না। কিন্তু। না। যুদ্ধের ব্যাপারে জড়িয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পাহাড়ে জঙ্গলে গিয়ে একজন একদিন একটা অনাচার করেছিল, এ থেকে কী বিচার করা যায় মানুষটা ভালো না খারাপ ছিল ? তাছাড়া আপনিও হয়তো জানেন না ঠিক কী ঘটেছিল। এমনও তো হতে পারে যে আপনার স্বামী বুনো মেয়েটাকে মজাতে যাননি, বাঁচাতে গিয়েছিলেন। নন্দ স্তম্ভিতা হয়ে গিয়েছিল সত্যই। বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়েছিল। তার ভাব লক্ষ করে নিজের বক্তব্য আরেকটু স্পষ্ট করা উচিত মনে করেছিল সুনীল। মানুষ হঠাৎ একটা অপকর্ম করে বলতে পারে না তা নয়। কিন্তু এটা স্রেফ একটা আলগা থিয়োরি। কী ঘটনা সঠিক না জেনে, অকাট্য প্রমাণ না পেয়ে, কোনো মানুষ সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত করা চলে না যে সত্যই সে অন্যায্য কাজটা কবেছে। ও রকম আন্দাজি বিচার মানুষ নিজের সুবিধার জন্য করে। বিনা বিচারে আটক আইনটা যেমন দেশের ভালোর নামে শাসকদলের সুবিধার জন্য, আন্দাজে একটা মানুষকে খারাপ ভাবাও তেমনি নিজের সুবিধার জন্য। নন্দা উত্তেজিত হয়ে বলেছিল, দেখুন, এমন আশ্চর্য ব্যাপার। আমিও মনে মনে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমিও তো ভালো কবেই জানতাম মানুষটাকে। পাঁচ বছর একসাথে ঘর করেছি। ! হঠাৎ ও রকম তার মতি হয় কী করে ? আপনি যে আমার কী উপকারটা করলেন আজ ! পরদিন দেখা গিয়েছিল। থান পরে নন্দা বিধবার বেশ ধাবণ করেছে। কেমন দেখাচ্ছে ? সুনীল প্ৰশান্ত মুখে তাকিয়েছিল, কিছু বলেনি। ছেলেমানুষি ভাবছেন তো ? কেন তা ভাবব ? আপনার কাছে এটা কত গুরুতর ব্যাপার জানি না। আমি ? কয়েকদিন বাদেই আবার সে আগের মতো কুমারী বেশ ধারণ করেছে। পড়ার তাগিদে সকলকে অন্যঘরে পাঠিয়ে দিলেও নন্দ পড়ায় মন দিতে পারে না। তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাবার জন্য সে যে খুব খাটছে সেটা স্পষ্টই বােঝা যায়। তিন মাস আগেও মুখে তার কমনীয়তা ভেসে থাকত। সেটা প্ৰায় উপে গেছে। এসেছে একটু শুকনো ভাব-দৃঢ়তাব্যঞ্জক বুক্ষতা। বড়ো বড়ো পরীক্ষার আগে ছেলেমেয়েদের কঁচা মুখে যে ভাবটা আসে।