পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র অষ্টম খণ্ড.pdf/২০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

് Novo এ কী সর্বনাশের কথা ! কাগজটা বন্ধ করা তার কাছে সর্বনাশের শামিল বলেই এবার সে নিজে দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়েছে। হােক সে মেয়েমানুষ, সে ছাড়া আর কে আছে যে দরদ দিয়ে কাগজটা চালু রাখার চেষ্টা করবে ? নিজেকে তৈরি করতে তাই সে উঠে পড়ে লেগেছে। শচীন যদি শেষ পর্যন্ত কাগজ চালাবার ভার বইতে অস্বীকার করে নিজেই সে দায় ঘাড়ে নেবে। প্ৰাণপণে চেষ্টা করে দেখবে কাগজটা বঁচিয়ে রাখতে পারে কি না। এমন যার দায়িত্ববোধ সে কখনও দৃঢ়চেতা শক্ত সমর্থ একটা পুরুষের সংস্পর্শে এলেই প্রেমে পড়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে না। কিন্তু প্ৰেম সম্পর্কে তার নিজের এমন বিতৃষ্ণা কেন ? অনেকদিন পরে আজ আবার প্রশ্নটা তার মনকে বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছে। নন্দা সহজে তার প্রেমে পড়বে না। এ বিষয়ে সুনিশ্চিত হয়ে সে যে বিশেষভাবে স্বস্তি বোধ করছে- এটাই তুলে বড়ো করে ধরেছে। প্রশ্নটাকে { নারীপুরুষের পরস্পরের আকর্ষণ মোটেই তুচ্ছ বাজে ব্যাপার নয় তার কাছে, নারীদেহ বর্জন করেই পুরুষের শুদ্ধ পবিত্র উচ্চতর জীবন সম্ভব, এই ধাপ্লাবাজিতেও সে বিশ্বাস করে না। নারীপুরুষের মিলন সুস্থ স্বাভাবিক জীবনেরই একটা অঙ্গ। বৃহত্তর জীবনের জন্য বড়ো দায়িত্ব পালনের প্রয়োজনেই কেবল সংযমের মানে হয়, নিজের আর আধ্যাত্মিক প্রয়োজনের ফকির খাতিরে সংযমের নামে আত্মপীড়নকে সে অসুস্থতা, বিকারগ্রস্ততা বলেই জানে। নৈতিক কোনো কুসংস্কারের ধার সে ধারে না। অথচ প্রেমের নামেই বিমুখ হয়ে ওঠে তার হৃদয়-মন । টিউশনি খুঁজতে গিয়ে পর্যন্ত সে এমন ছাত্রী বেছে নেয়, যে তার প্রেমে পড়ে যাবে এ আশঙ্কা অপেক্ষাকৃত কম। আরও একটা কথা আজ খেয়াল হয়। সুনীলের। খেয়াল হয় যে ঘটনাচক্ৰে যে দুটি টিউশনির খোঁজ পেয়েছিল, দুটিতেই ছিল মেয়েকে পড়বার প্রয়োজন। তার মধ্যে একজনকে সে বেছে নিয়েছিল। কিন্তু এদের দুজনকেই বাতিল করে কোনো ছেলেকে পড়বার টিউশনি খুঁজে নেবার কথা তো তার মনেও আসেনি ? তার বিতৃষ্ণা কি তবে প্ৰেম সম্পর্কে নয় ? রেবার মতো উমার মতো মেয়েরা যেটাকে প্রেম মনে করে সেটাই তার অপছন্দ ? কিন্তু মেয়ে তো এরা বদ নয়, পাকা ঝানু নয়। প্ৰেম তো তামাশা নয়। এদের কাছে। ভুল বুঝে থাকতে পারে রেবা, কিছুদিন বাদে নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে তার প্ৰেম, কিন্তু এই প্রেমকে আশ্রয় করে তুবড়ির মতোই তো প্ৰচণ্ড শক্তিতে উৎসারিত হয়ে উঠেছে সরল ছেলেমানুষ মেয়েটার আবেগ, কল্পনা, স্বপ্ন, অনুভূতি, সব কিছু। হয়তো এই উন্মাদনাই প্রেম-প্ৰেম ব্যাপারটাই এ রকম, সে পছন্দ কবুক আর না করুক। এই রকমই রীতিপ্রকৃতি প্রেমের। সে যে গুরুগভীর ভারিকি প্রেমের কথা ভাবে সেটাই একটা অসম্ভব অবাস্তব কল্পনামাত্র। প্রতিদিনের মতো আজও রেবা দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির সামনের চার-পাঁচহাত লম্বা-চওড়া বাগানটুকুতে। আজকাল রেবা শান্ত সংযতভাবে কথা বলে, একটু উদাসীনভাবে। মুখে থমথমে ভাবটুকু বজায় থাকে। কিন্তু সেটা ক্ষোভ, বা অভিমানের জন্য মনে হয় না, এটা যেন তার নীরব ভৎসনার প্রতীক।