পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র অষ্টম খণ্ড.pdf/৩২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সার্বজনীন VORM মায়ের দেহের সারাংশ চুষে নিচ্ছে, একটু তাতে কম পড়লেই প্ৰাণপণে টু মারে। গাইটি আর পারছিল না। দুধ ছাড়তে, বন্ধ করে দিতে চাইছিল সাপ্লাই। বাছুরের গতোয় আবার সে খানিকটা দুধ ছাড়ে রিজার্ভ ফান্ড থেকে। বাছুরটা কী নিষ্ঠুর ? গোয়ালা বাছুরটাকে বেঁধে রেখে প্ৰায় সব দুধ দুয়ে নিয়েছে, তাই বাছুরটাকে গুতো মারতে হয়। আমিও তো তাই বলি। বাছুরগুলি ও রকম গুতো মেরে দুধ আদায় করে বলেই তো গোয়ালারা কচিবাছুর মেরে ফেলে। চামড়াটা ট্যান করিয়ে ভিতরে খড় পুরে চারটি বাঁশের বাতায় ঠ্যাং লাগিয়ে গোবুটাকে ভুলায়। খড়-ভরা শুকনো চামড়া চাটতে চাটতে পশ্চিমের মস্ত গাই বালতি-ভরা দুধ ছেড়ে দেয়-তার প্রত্যেক সেরের দাম এক টাকা। রোজ দেয়। ভুল ভাঙে না। সকালবেলাই কেমন বিষাদ অনুভব করে পদ্মা। নতুন গাড়ি চেপে এ পাড়ায় বেড়াতে আসার উৎসাহ কোন ফাকে উপে গেছে। সবিতা গান শিখছিল অসীমের কাছে। তার গলায় গ্ৰাম্যতা এখনও স্পষ্ট হয়ে আছে সুরে আর টানে । পলা সাধা বন্ধ করে জিজ্ঞাসা করে, সমীরবাবু আসেননি ? পদ্মা বলে, না। পরে আসবে। পদ্মা জানে তারা গাড়ি দেখাতে আসছে বলেই সমীর তাদের সঙ্গে আসেনি। এখন তারও মনে হয়, সত্যি, এ ক্যামন গ্ৰাম্যতা তাদের ? এত দামি দামি গাড়ির ছড়াছড়ি কলকাতা শহরের আর তুচ্ছ একটা গাড়ি কিনে তারা একটু ঈর্ষা জাগাতে এসেছে এ পাড়ার সেকেলে রক্ষণশীল মানুষদের বুকে-- যাদের সঙ্গে মিল না খাওয়ায় তাদের পালাতে হয়েছে। অন্য পাড়ায় ! পদ্মাও এভাবে চিন্তা করে ? সস্তা নভেল আর সস্তা সিনেমা মানুষ আর জীবনকে যে বেচারির কাছে এত সস্তা করে দিয়েছিল যে নিজের সুন্দর দেহটার সাহায্যে পরমেশ্বরের মতো মানুষকেও জব্দ করতে যেতে এই সেদিনও যার দ্বিধা জাগেনি ? সেদিন মা বলে ডেকে পরমেশ্বর কি তার এই দশা করেছে ? এভাবে চিস্তা করতে অনুভব করতে শিখিয়েছে ? কিন্তু মা বলে ডেকেই যদি বিষিয়ে তোলা কঁচা মনে মানুষ আর জীবনকে শ্রদ্ধা করার অমৃত সৃষ্টি করে নিজের উপরেও শ্রদ্ধা জাগানো যেত। তবে আব্ব ভাবনা ছিল কী ! পদ্মা শুধু ভড়কে গেছে। ভদ্র জীবনের মিথ্যা। আর ফাকিগুলিই আরও বেশি করে ধরা পড়ছে তার কাছে। নইলে সুরঞ্জন অধ্যাপক হয়েছে শুনে আত্মগ্লানিতে তার মন এমন বিরূপ হয়ে ওঠে যে এ বাড়িতে এসেও একবার ওদের পিছনের অংশটুকুতে যেতে অনিচ্ছা বোধ করে ! ইতিমধ্যে সুরঞ্জন কলেজ থেকে তিন-চারবার তাদের বাড়ি গিয়েছে। তার জন্যই গিয়েছে সে তো জানা কথাই। চাকরি পাওয়ার আগে পর্যন্ত সুরঞ্জন খুব সংযতভাবে তার সঙ্গে মিশত। ঘনিষ্ঠতা বাড়াবার কোনো চেষ্টাই করত না। এখন সে ঘনিষ্ঠ হতে চায়। অত্যন্ত সদিচ্ছা নিয়েই চায় তাতে সন্দেহ কী ! কিন্তু চাকরি পাওয়া না পাওয়ার উপরেই যে সদিচ্ছা নির্ভর করে সেটা সার্থক করার জন্য তার সঙ্গে এবার বেশি করে মিলেমিশে একটা ভালোবাসা তৈরি করে নেবার কোনোই তো দরকার নেই। সোজাসুজি বিধুভুষণের কাছে গিয়ে প্রস্তাব করলেই পারে। ভালো ছেলে, ভবিষ্যৎ আছে বিধুভুষণ রাজি হয়ে যাবে।