পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র অষ্টম খণ্ড.pdf/৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 SR মানিক রচনাসমগ্র লক্ষ্মী সংশয় ভরে বলে, আমারও মনটা যেন বলছিল নন্দ বলে, সত্যি চুরি হলে এতক্ষণ ভিড় জমে যেত না ? লক্ষ্মী বলে, তাই তো বটে ! এ যেন গাঁয়ে জনমনিষ্যি নেই ! শুভ বলে, কী ব্যাপার ? সব যে রহস্যময় ঠেকছে ? নন্দ বলে, রহস্য কিছু নয়, সাদাসিদে ব্যাপার। তুমি বরং আমার ওখানে গিয়ে বসবে যাও। দেখি কী ব্যবস্থা করা যায়। ব্যাপারটা শুনি না ? ব্যাপার এই--তোমার সঙ্গে একটু তামাশা করেছে। তোমায় একটু জব্দ করতে চায়। শুভ যেন আকাশ থেকে পড়ে, জব্দ করতে চায় ? আমাকে ? সবেমাত্র দেশে ফিরলাম, আমি তো। কারও কিছু ক্ষতি করিনি ! নন্দ হেসে বলে, তুমি হয়তো করনি। যে বুদ্ধিমানের মগজে প্ল্যানটা গজিয়েছে তোমাদের জাতটার ওপরেই হয়তো তার রাগ। তোমায় গাড়িটা রেখে যেতে দেখেই ভেবেছে, তামাশা করার বেশ সুযোগ মিলেছে ! কিন্তু এ তো একজনের কাজ নয় ! নন্দ মাথা নাড়ে । গাঁ-সূদ্ধ লোক সায় দিল ? শূভর গলার আওয়াজে বিস্ময় বা আপশোশের চেয়ে কাতরতা বেশি ফুটেছে খেয়াল করে লক্ষ্মী তাড়াতাড়ি বলে, না না, তাই কখনও দেয় ! দু-চারজন কাজটা করেছে, অন্যেরা তফাত হয়ে থেকেছে৷ এইমাত্র। মাথা হােঁট করে শুভ নন্দর ডিসপেনসারিতে ফিরে যায়। বিদেশে অনেক মাথা ঘামিয়ে গড়া পরিকল্পনা মাথার মধ্যে ভেঙে চুরমার হয়ে যাবার ব্যাপারটা তুচ্ছ হয়ে গেছে একেবারে। আজ এখন যেন সত্যি ভেঙে চুরমার হয়ে গেল তার সব কল্পনা আর স্বপ্নের ভিত্তি। প্রতি পদক্ষেপে তার মনে হয়, চারিপাশে কাছে ও দূরের ঘরগুলির জানালা দরজা দিয়ে উকি মেরে তার দিকে চেয়ে গায়ের মেয়েপুরুষ নিজেদের মধ্যে হাসােহাসি করছে, খেতে আর মাঠে মানুষ তাকে দেখে তার দিকে পিছন ফিরছে, হাসি চেপে রেখে পথ দিয়ে লোক তার পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। এর চেয়ে টায়ার আর পার্টস কটা সত্যি সত্যিই চুরি যাওয়া অনেক ভালো ছিল। সম্পূর্ণ গাড়িটা চুরি গেলেও তার এতখানি দুঃখ হত না। আধঘণ্টা পরে নন্দ ফিরে আসে। জানায় যে গাড়ির খুলে নেওয়া অংশগুলি ফিট করা হচ্ছে। তোমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে ভাই। যদি তুমি চাও সামনে এসে মাপ চাইতেও রাজি আছে। শুভ নীরবে মাথা নাড়ে। নন্দ বলে, দুঃখ করো না। তোমার মনে কী আছে কেউ তো জানে না, তোমাকেও দলে ভিড়িয়ে দিয়েছে। লক্ষ্মী যা বলেছে কথাটা ঠিক, কাজটা আসলে দু-পাঁচজনের। আগে হলে হত কী, গায়ের দশজন ওদের বাধা দিত। আজকাল সবার প্রাণে বড়ো জ্বালা । তা হলে একলা পেয়ে আমাকে ওরা খুন ও তো করতে পারে, দশজনে তাকিয়ে দেখবে ? অকারণে খুন কেউ করবেও না, দশজনে সইবেও না। সে জন্য আগে তোমাকে তাহলে একটা বড়ো রকম অপরাধ করতে হবে, দশজনে যাতে তোমার মরাই ভালো মনে করে। তখন কেউ এগিয়ে গিয়ে তোমায় মারলে সবাই চুপ করেই দেখবে। এখানে কেন, সব দেশেই এই নিয়ম।