পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র অষ্টম খণ্ড.pdf/৪৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

5에 88 ○ নরেন বলে, আপনারা বুঝছেন না কথাটা। মানুষের খেয়ালখুশি থাকবে না, কোনো শখ থাকবে না ? ওকে যে আমি পড়াচ্ছি, এটা আমার কাছে সিনেমা দেখা, খেলাধুলা করার মতো। ওকে পড়িয়ে আমি আনন্দ পাই। একটা কিছু নিয়ে থাকবে তো মানুষ ? শুনে মা-বাবা নির্বাক হয়ে যায়। উষা বলে, বিয়ে করতে বলছি। সবাই তার কথা কানে না তুলে নরেন আবার বলে, ওকে না পড়িয়ে আমি যদি সকল সন্ধ্যা তাস পাশা খেলে কাটােতাম, তোমরা কিছু বলতে ? সেই সময়টা আমি অন্য একটা খেয়াল মেটাতে চেষ্টা করছি। ! সোজা খাটুনি একটা ছেলেকে স্কুলান্তক পরীক্ষায় ফাস্ট হবার জন্য তৈরি করতে কোমর বেঁধে লেগে RN3 ছেলে পড়ানো অভ্যাস ছিল না-তবে নিজে স্কুল ডিঙিয়ে কলেজ থেকে বেরিয়েছে অল্পদিন আগে। পড়া আর পড়ার খুঁটিনাটি কায়দাকানুন বিনোদের মতো ইতিমধ্যে সব ভুলে যায়নি। কিন্তু মণ্টকে পড়াতে পড়াতে বারবার তার উৎসাহ ঝিমিয়ে আসে, দেহমনে রীতিমতো ক্লাস্তি বোধ হয় । চোখের সামনে সে দেখতে পাচ্ছে মন্টুর এই পরীক্ষা পাসের কৃতিত্বের নিস্ফল ভবিষ্যৎ । বৃত্তি পেলেও, পড়া চালিয়ে যেতে পারলেও বিশেষ কিছু সে আর করতে পারবে না। এই লাইনে। গরিবের ছেলে কি পাসের সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠে না? সে রকম দৃষ্টান্ত কি নেই ? আছে বইকী ! তারা অসাধারণ। মণ্টস্ট্রর মতো সাধারণ ছেলেদের সঙ্গে তাদের তুলনা করা চলে না। মণ্টস্ট্রর সে গুণ নেই। সে নরম। তার বড়ো হবার স্বপ্ন শুধু মা-বাবা ভাইবোনদের কষ্ট দূর করা। ঘেরা রোয়াকিটুকুতে ছেড়া ময়লা কাপড় পরা মণ্টর মা রান্না করে আর থেকে থেকে মুখ তুলে তাদের দিকে তাকায়। বিষগ্ন শুকনো মুখে মালতী ঘরের কাজ করে যায়। মালতীকে দেখে মনে হয় তার বোধ হয় কোনো অসুখ আছে। ছোটাে ছেলেমেয়ে ক-টা বাইরে কোথায় খেলছে। মাঝখানে একবার বাড়ি এসেছিল, মালতীর ধমকে আবার পালিয়ে গেছে। মণীন্ট্রর পড়ার সময় তাদের বাড়িতে খেলা করা বারণ। বাড়ির মধ্যে রোজ দু-তিনঘণ্টা এভাবে বসে থাকার ফলে আপনা থেকেই এই অশিক্ষিত গরিব পরিবারটির চালচলন নজরে পড়ে নরেনের। কতকালের পুবনো কত অন্ধকার যে জমাট বেঁধে আছে এদের চেতনায়! কত সংস্কার, কত অন্ধবিশ্বাস কত ভীরুতা ! ' কিন্তু সমালোচনা জাগে না। নরেনের মনে। তাদের শিক্ষিত পরিবারে মানুষগুলির চেতনা তো মুক্ত নয়। এ সব সংস্কার, বিশ্বাস আর ভীরুতা থেকে ! কতগুলি কেবল তলিয়ে গেছে মনের তলায়, কতগুলির ঘটেছে বুপান্তর। মিলিয়ে যায়নি, শেষ হয়ে যায়নি-নূতন ধারণা ও বিশ্বাস গড়ে ওঠেনি। সেগুলির স্থান দখল করে। তবে অন্যায় আর অনিয়মের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জন্মেছে প্ৰচণ্ড। যেমন তাদের শিক্ষিত পরিবারের মানুষগুলোর মনে, ঠিক তেমনই এই বাড়ির অশিক্ষিত মানুষগুলির মনেও। একদিন এই বিক্ষোভ চেতনার সংস্কার ও ভীরুতার নাগপাশের বাঁধন ছিন্নভিন্ন করে দেবে বইকী !