পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র তৃতীয় খণ্ড.pdf/১২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শহরতলি S Sፃ সুবর্ণের বিবাহ হয় নাই, কিন্তু এমন সাজাটাই সে সাজিয়াছে যেন বিয়ের কনেটি, আজিকার উৎসবটি যেন তারই বিবাহের ভূমিকা-সাজগোজেই যেখানে যত বর আছে সকলকে আজ সে আয়ত্ত করিয়া রাখিবে। আনন্দে ও উত্তেজনায় মেয়েটা ফাটিয়া পড়বার উপক্ৰম করিতেছিল, যশোদার জবাবে একটু দমিয়া গেল। বউ বুঝি তোমাব পছন্দ হয়নি। যশোদাদিদি ? এত বড়ো মেযের ন্যাকামিতে যশোদার গা জুলিয়া যায়। সে বলিল, আমার পছন্দ অপছন্দ কী বোন, আমি তো বিয়ে করিনি ? তোমার দাদার পছন্দ হলেই হল। দিদির পিছনে পিছনে আরও একবার বউ দেখিতে আসিয়া নন্দ হাঁ করিয়া সুবৰ্ণকে দেখিতেছিল, এবার সে যশোদাব কথােব প্রতিবাদ করিয়া বলিল, কেন, বউ তো সুন্দর, আমার খুব পছন্দ হয়েছে। যশোদা মুখ ঘুরাইয়া বলিল, ফোঁড়ন না কেটে তুই যা তো এখান থেকে নন্দ, এত বয়স হল তোর কথা বলতে শিখলি না এখনও ? অন্যায় কথাটা কী বলিয়াছে বুঝিতে না পারিয়া নন্দ মুখভার করিয়া সরিয়া গেল। বউকে দেওয়ার জন্য যশোদা একখানা সস্তা রঙিন শাড়ি আনিয়াছিল, শাড়িখানা বউয়ের হাতে দিতে একটা অদ্ভুত মুখভঙ্গি করিয়া সুবৰ্ণও সরিয়া গেল। কেবল সুবর্ণ নয়, আরও অনেকের মনে হইতে লাগিল, বউযেবা জন্য উপহার আনিয়া এবং এমন সস্তা একখানা শাড়ি বউয়ের একেবারে হাতে দিয়া, যশোদা সকলকে অপমান করিয়াছে। একে দুয়ে আসিয়া সকলে বউ দ্যাখে। কেউ একখানা বই দেয়, কেউ সিঁদুরের কীেটা, কেউ কিছুই দেয় না। জ্যোতির্মােয়ব দিদি আর বউদিদি মেয়েদেব অভ্যর্থনা করেন, পুরুষদের অভ্যর্থনা কবেন জ্যোতির্মযোেব কাকা এবং দাদা। জ্যোতিময় নিজে একটি মটকার পাঞ্জাবি পরিয়া এখানে ওখানে দাঁড়ায, রাস্তায় চোখ পাতিয়া রাখে। বড়ো অন্যমনস্ক মনে হয় জ্যোতির্মযকে, বড়ো চঞ্চল মনে হয়। একজন বন্ধু জিজ্ঞাসা করে, সত্যপ্ৰিয় আসবে নাকি হে ? জ্যোতির্ময় চমকাইয়া বলে, আঁ ? কে, কর্তা ? হ্যা, আস পােবন। ঠিক অবহেলা নয়, স্পষ্ট বোঝা যায সত্যপ্ৰিয়র আগমনের আশায় অথবা আশঙ্কায় জ্যোতির্ময় কারও দিকে ভালো করিযী। চাহিয়াও দেখিতে পারিতেছে না। আপিসের লোকেরা ব্যাপারটা বুঝিতে পাবে, অন্য সকলে বুঝিতে না পারিলেও খানিক খানিক অনুমান করিতে পারে। তারপর সত্যই সত্যপ্ৰিয আসিল। সত্যপ্ৰিয এত বড়ো ধনী, যত না ধন তার আছে মানুষের কল্পনায় তার পরিমাণটা এত বেশি। বাড়িয়া গিয়াছে যে, সাধাৰণ লোকের বাড়ি সামাজিক নিমন্ত্রণ রাখতে গেলে, সকলে অতিমাত্রায় ব্যস্ত ও বিব্রত হইয়া পড়ে। এই জন্য এই সব বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করিবার একটি সুন্দর পদ্ধতি তার নিজেকেই ঠিক করিয়া লইতে হইয়াছে, সকলের আদর, অভ্যর্থনা ও ভদ্রতা করিবার ব্যাকুলতাকে লোকটা এমন কৌশলে নিজেই খানিক খানিক পরিচালনা করে বলিবার নয়। যেখানে প্রতিনিধি পঠাইয়া কাজ। সারা যায়, সেখানে অবশ্য সত্যপ্রিয় কখনও যায় না, সকলকে সামলাইয়া চলিবার হাঙ্গামাও পোহাইতে হয় না। মস্ত মোটর আসিয়া থামে, সত্যাপ্ৰিয নামিয়া আসে-খালি হাতে। জ্যোতির্ময়ের বউয়ের মুখ দেখিবার জন্য উপহার একটা সে আনিয়াছে, কিন্তু এত বড়োলোক সত্যপ্রিয়, সে কি উপহার হাতে করিয়া নামিতে পারে ? উপহার হাতে থাকে ভূষণের, সে সত্যপ্রিয়র আত্মীয়, বন্ধু, চর বা অনুচর একটা কিছু হইবে। মখমলে মোড়া দামি সুদৃশ্য একটি বাকসো, দেখিলেই বোঝা যায় ভিতরে দামি কিছু আছে।