পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র তৃতীয় খণ্ড.pdf/১৫৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শহরতলি >Q○ অতি যত্নে নন্দ সব সাজাইয়া গুছাইয়া বাখে, মসৃণ ও সমতল করিয়া লাল নীল পেন্সিলের দুটি মুখ কাটে, লালকালির কলম ভুলিয়াও কখনও কালো কালিতে ডুবায় না, খাতার কাগজে লিখিবার সময় ধরিয়া ধরিয়া সাবধানে লেখে, খামে ভরিবার আগে প্রচারপত্রটির সঙ্গে জ্যোতির্ময়ের লিখিত পত্রটি ক্লিপ দিয়া আঁটিবে না পিন দিয়া আঁটিবে এ কথাটি পর্যস্ত জ্যোতির্ময়কে জিজ্ঞাসা করিয়া নেয়। আর পরম উৎসাহে আপিসের নিয়মকানুন আয়ত্ত করার চেষ্টা করে। জ্যোতির্ময় গভীর মুখে বলে, অনাথবাবু ঘরে এলে উঠে দাঁড়িয়ো। নন্দর মুখ স্নান হইয়া যায়, ভয়ে ভয়ে বলে, উনি বাগ কবেননি তো ? আর কে কে এলে উঠে দাঁড়াবা ? বলে দেবখনা । বাড়ি ফিবিতে সন্ধ্যা হইয়া যায়। তার শুকনো মুখ দেখিয়া যশোদা মনে মনে রাগ করিয়া ভাবে, সামান্য একটা চাকবির পরিশ্রম পর্যন্ত সইবার ক্ষমতা নেই শরীরে, কেন জন্মেছিলি তুই পৃথিবীতে ? ভাইকে সে দুধ খাওয়ায়, কলা খাওয়ায়, সন্দেশ খাওয়ায়-চাকরির শ্ৰমে ক্লাস্ত শরীরটা যদি ভালো ভালো খাদ্য পাইয়া একটু পুষ্ট হইতে রাজি হয়। সন্ধ্যার সময় যশোদা বাধাবাড়া নিয়া ব্যস্ত থাকে, তখন অবসর হয না, বাত্রে নন্দ চাকবির গল্প করে—সমস্ত দিনের প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি ব্যাপারের বিস্তারিত কাহিনি। নন্দব আনন্দ ও আগ্রহ যশোদাকে পীড়ন করে। শুনিতে শুনিতে মনে তার খটকা লাগে যে, চাকরি কবিতে গিয়া বাস্তব জগতের সংস্পর্শে আসিয়া নন্দর মন শক্ত হইবে এ আশা বোধ হয় মিথ্যা। যে জগতে নন্দ মানুষ হইযাছে সেখানকাব বাস্তবতা কী কম কঠোর, কম সর্বগ্রাসী ? তাই যদি নন্দকে স্পর্শ কবিতে না পাবিদ্যা থাকে, সত্যাপ্রিযর আপিসের বাস্তবতা কি পরিবে ? এক একটা ছেলে বোধ হয এইরকম বর্মপরা মন নিয়া জন্মায, পৃথিবীব ধুলাকাদা সে মনের নাগাল পায় না। পাপ পর্যন্ত তাবা করে পুণ্য করাব মতো নির্দোষ আগ্রহের সঙ্গে। যে সব ছেলের সঙ্গে নন্দ এতকাল আডিডা দিত, এখনও সকল সন্ধ্যায় দিতেছে, তাদেব কাছে বখামি পাকামি শিখিতে কি কিছু তার বাকি আছে ? কিন্তু কী কাজে লাগিয়াছে তাব ও সব শিক্ষা ? ছেলেমানুষি ঘোচে নাই, মন পাকে নাই, কয়েকটা কেবল বিকার জন্মিয়াছে মনের, কদৰ্য এবং কুৎসিত। বসিযা বসিয়া স্বপ্ন দেখার তাতে তার কিছুমাত্র ব্যাঘাত হইয়াছে বলিয়া মনে হয় না। খারাপ দিকেও কিছু অভিজ্ঞতা জমিয়া নন্দর মনটা যদি একটু শক্ত হইত, শিশু ভিখারি। আর কিশোরী মেয়েব মতো ভয, লজ্জা, অভিমান বিনয়, নির্ভবশীলতা, সংকোচ, স্বপ্ন দেখা এ সব যদি একটু কমিত, বাঁচিয়া থাকাই যে একটা ভীষণ লড়াই এ বিষয়ে সামান্য একটু জ্ঞান জন্মিযা ভাবপ্রবণতাটা খানিকটা নিস্তেজ হইয়া আসিত, তা৩েও বোধ হয় খুশি হইত। একদিন সত্যপ্রিয় মহাসমারোহে বাপের বার্ষিক শ্রাদ্ধের আয়োজন করিয়াছে, রাজ্যের লোককে আহারের নিমন্ত্রণ করা হইয়াছে, একদলকে মধ্যাহেৰ আর একদলকে রাত্রে । আপিসের সকলে রাত্রে সত্যপ্রিয়ার বাড়ি খাইতে যাইবে। হঠাৎ দুপুরবেলা সত্যপ্রিয় আপিসে আসিয়া হাজির। কেউ স্বপ্নেও ভাবে নাই সেদিন সে আপিসে আসিবে। সকলেই কমবেশি গা এলাইয়া দিয়াছিল-কেরানিরা পর্যন্ত। কেরানিদের সঙ্গে সত্যপ্ৰিয়র এক রকম কোনো সম্পর্কই নাই, তাদেব উপর অনেক উপরওয়ালা আছে, অন্যদিন যারা তাদের এক মুহূর্তের জন্য ঘাড় তুলিতে দেয় না। সত্যপ্রিয় না আসিলেও তাদের কাজে ঢ়িল পড়িবার কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু কেবল একজনের কড়াকড়িতে যেখানে নিয়মতান্ত্রিকতা জেলখানার অত্যাচার হইয়া দাঁড়ায়, একটি মাত্র স্কু আঁট থাকিলে যেখানে সংগঠন খাড়া থাকে, সেই একজনের অভাবে স্কুতে ঢ়িল পড়িলেই নিয়ম শিথিল হয়, সংগঠনে আলগা পড়ে। অন্যদিন সত্যপ্রিয় না আসিলেও কিছু আসিয়া যায় না, তার আসিবার সম্ভাবনাতেই যথারীতি কাজ চলিতে থাকে। কিন্তু আজ সত্যপ্রিয়র আবিভােব এক রকম অসম্ভব জানা থাকায় কাজে কারও মন মানিক ৩য়-১১