পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র তৃতীয় খণ্ড.pdf/১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SVe মানিক রচনাসমগ্ৰ শাস্তু যথোচিতভাবে কৃতজ্ঞতা জানাইল। স্বামীদের যেভাবে স্ত্রীকে কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত ঠিক সে ভাবে নয়, নম্রভাবে, সবিনয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে। এই সময় বেড়ার ও পাশে হঠাৎ শোনা গেল, ছোটােবউ ক্ষেস্তির খিলখিল হাসি। বেড়ার ফুটায় সে চোখ পাতিয়া ছিল নাকি এতক্ষণ, তাদের আলাপ শুনিতেছিল ? রান্নাব চালাটার পিছন দিয়া ঘুরিয়া সরলা চোখের নিমেষে ও বাড়িতে গিয়া হাজির হইল। বৈদ্যনাথ ক্ষেস্তি আর বাড়ির কুকুরটা ছাড়া উঠান নির্জন। উঠানের বেড়া আর ধানের মরাইটার মাঝখানে দাঁড়াইয়া রসিক বৈদ্যনাথ স্ত্রীর সঙ্গে রসিকতা করিতেছিল। সবাই কোথা গেছে লো ছোটোবউ ? কাছে আসিযা ক্ষেস্তি ফিসফিস করিয়া বলিল, ঘরে। সেটা সম্ভব। চৈত্রের দুপুরে ঘরের বাহিরে কড়া রোদ, গরম বাতাস। কিন্তু এদের দুজনের কি ঘর নাই ? এখানে এরা কী করিতেছে। এ সময় ? হাসিাহসি ? নিজের বাড়িতে ফিরিয়া বারান্দা ছাড়িয়া এবার সরলা ও শম্ভু ঘরে গেল। তিন পুরুষের পুরানো পালঙ্কে (ভিন্ন হওয়ার সময় ভাইদের কবল হইতে শাস্তু সেটা কী কৌশলে বাগাইয়াছিল। আজও সরলা তাহা বুঝিতে পারে না। ) শূইয়া সরলা চোখ বুজিল, শান্তু বসিয়া বসিয়া টানিতে লাগিল তামাক। নিজেই তামাক সাজে কি না। শভু, এত বেশি তামাক দেয় যে তামাক শেষ হইতে হইতে দুপুরে এবং রাত্রে দু-বেলাই সরলার ধৈৰ্য্যুতি ঘটে। আজ দেখা গেল সে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। হয় বাপেৰ সঙ্গে সমস্ত সকালবেলাটা লড়াই করিয়া না হয় বৈদ্যনাথ ও ক্ষেস্তিকে ধানের মরাইয়ের আড়ালে রোদে দাঁড়াইযা হাসাহাসি করিতে দেখিয়া সরলা বোধ হয় শ্রাস্ত হইয়া পড়িয়াছিল। দিন সাতেক পরে শাস্তু সকাল বেলা সরলার বাবার কােছ হইতে টাকা আনিবার জন্য রওনা হইয়া গেল। গেল ও বাড়ি হইয়া। দোকানে নূতন মাল আনা সে কিছুদিন আগেই বন্ধ করিয়াছিল, অনেক জিনিস ফুরাইয়া গিয়াছে, অনেক খদের ফিরিয়া যায়। মনিহারি দোকানে যে সব জিনিস রাখা চলিবে না,-চাল ডাল মশলা পাতি, সে সব শেষ হইয়া যাওয়াই ভালো। তাই আজকাল একটা দিনের জন্যও দোকানটা সে বন্ধ রাখিতে চায় না। বৈদ্যনাথ আসিয়া দোকানে বসিবে। বেকার রসিক বৈদ্যনাথ । শভুর যে ছোটাে ভাই এবং যে দুপুর রোদে উঠানে ধানের মরাইয়ের আড়ালে দাঁড়াইয়া বউয়ের সঙ্গে হাসােহাসি করে। শাস্তুও একদিন বেকার ছিল, বউও ছিল শাস্তুর—ছ্যাকড়া গাড়ির ঘোড়ার মতো হাডিডাসার হােক, বউ বউ। ক্ষেস্তিই বা এমন কী রূপসি পরির মতো ? ওর মাথায় বরং ছিট আছে, এক বছর আগেকার সরলার মতো কম খাইয়া বেশি খাটিতে খাটিতেও কারণের চেয়ে অকারণেও বেশি খিলখিল করিয়া হাসে। বেকার অবস্থায় একবারও নয়, দোকানদার হওয়ার পর শাস্তুকে কয়েকবার হাসােহাসি করিতে দেখিয়াছে সরলা, কিন্তু সে অন্য একজনের সঙ্গে। তারপর শাস্তু বউকে কিনিয়া দিয়াছে ডুরে শাড়ি। অন্য অনেকের সঙ্গেই বৈদ্যনাথ হাসােহাসি করে, ক্ষেস্তিকে কিন্তু কখনও কিছু কিনিয়া দেয় না। কী করিয়া দিবে ? পয়সা নাই যে ! দু-ভায়ের মধ্যে প্রভেদটা কী আশ্চৰ্য্যজনক । নামে নামে পর্যন্ত শুধু “নাথ’-এর মিল, ওটা বাদ দিলে একজন শম্ভু অন্যজন বৈদ্য । মল না বাজাইয়া দোকানে তাকের আড়ালে দাঁড়াইয়া সরলা বৈদ্যনাথের অনভ্যস্ত দোকানদারি দেখে। মালপত্রের অভাবে কেমন ফাঁকা ফাকা লক্ষ্মীছাড়া মনে হয় দোকানটা । কদিন হইতে মনটা ভালো ছিল না। সরলার, উচু দাঁত দুটি অনেক সময় ঢাকা পড়িয়া যাইতেছিল। পাকা দোকানির মেয়ে সে, কঁচা দোকানির বউ, তার কেবল মনে হইতেছিল ভুল হইয়াছে, ভুল হইয়াছে, শুধু লোকসান নয়, একেবারে সে দেউলিয়া হইয়া যাইবে এবার। কিছুদিন হইতে কী রকম যেন হইয়া উঠিয়াছে পারিপার্শ্বিক অবস্থােটা তার ; সে বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছে না,