পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র তৃতীয় খণ্ড.pdf/১৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SW মানিক রচনাসমগ্ৰ যশোদা বলিল, আমাদের খাওয়া দেখে হাসছে আর কী। দোকানির হাসি নিভিয়া গিয়াছিল, হাতজোড় করিয়া সে তাড়াতাড়ি বলিল, আজ্ঞে না গিন্নিম, খাওয়া দেখে কী হাসতে পারি ! আপনারা খাবেন আজ্ঞে, তবে তো আমাদের দুটাে পয়সা ! আপনাদের দেখে বড়ো আনন্দ হল। কিনা মনে, তাই হাসলাম একটু মনের সুখে। আমার একটি দিদি। আছে গিন্নিমা, আমার পিসতুতো দিদি, তেনাও আপনারই মতো আজ্ঞা। যশোদা বলিল, বটে নাকি ? দোকানি বলিল, আজ্ঞা। তবে তেনার বয়েসটা কিছু বেশি হবে, চুলে পাক ধরে গেছে। আমরা যাই, তা তামাশা করে বলেন কী যে গুরুজন আমি, আমায় পেয়াম কর রসিক। যেই পোন্নাম করতে মাটিতে মাথা ঠেকাই, মাথার পরে পা-টি তুলে দেয়। বাস সব নড়নচড়ন বন্ধ। পা-টি না সরালে আর মাথাটি সরাবার জো নেই। বেশ বুঝা যায় শেষটুকু বাড়ানো ও বানানো গল্প। যত শক্তিমতী পিসতুতো বোনই মাথায় পা রাখুক, মাথা নাড়ানো চলিবে না। এত জোরে পায়ের চাপ দিয়া তামাশা করার শক্তি তার থাকিতে পারে না, কারণ মাথায় ও রকম চাপ পড়িলে ডাক্তার ডাকিবার দরকার হয়। রসিক কেবল রসালো খাবারের দোকান করে নাই, মানুষটাও সে রসিক বটে। যশোদার শুনিতে বেশ মজা লাগিতেছিল। রসিক বলিল, কিন্তু হায় আদেষ্ট ! বোনাইটি আমার এই এইটুকুন মনিষ্যি-একটা বাচ্চা ছোকরার সমান। মা কালী আপনাদের কেমন সুন্দর মিল করেছেন দেখে তার কথাটা মনে পড়ল কিনা, তাই হাসছিলাম গিন্নিমা। অনেক বেলা হইয়াছে, গঙ্গার ঘাটে বসিবার আর সময় ছিল না, তবু দুজনে একটু বসিল। খাওয়াটা বড়ো বেশি হইয়াছে। অনেক নারী-পুরুষ ঘাটে স্নান করিতেছে, লজ্জােটা নারী ও পুরুষ উভয়েরই কম, মানুষের যতটা থাকা দরকার প্রায় ততটুকু-দেখিলে কে বলিবে তারা শহব বা শহরতলির অধিবাসী, স্নানের সময় অন্তত স্বাভাবিকতার পবিত্রতাটুকু পাওয়ার জন্যই যেন তারা বাড়তি সভ্যতা ত্যাগ করিয়াছে। আমি সত্যি হাতির মতো দেখতে, না ? কই না, তুমি তো মোটা নও। হাতি কী আর মোটা, হাতির চেহারাই হাতির মতো। কোথেকে যে হলাম। এমন । আমার বাপ-মা তো এমন ছিল না, আমার ভাইটা তো এমন নয়, বোন আছে একটা সে রীতিমতো সুন্দরী--- হ্যা, মাইরি বলছি তোমায়। বিশ্বাস হল না ? ধনঞ্জয় কী একবার যশোদাকে বলিতে গেল, তুমিও রীতিমতো সুন্দরী ? কথাটা কেমন শোনাইত কে জানে, জীবনে প্রথম একজন মানুষের কাছে কথাটা শুনিতে যশোদার কেমন লাগিল তাই বা কে জানে ! কিন্তু ধনঞ্জয় কথাটা জোলো করিয়া ফেলিল। এইভাবে যে, তুমিও তো খুব বেশি খারাপ নাও। খুব বেশি না হই-খারাপ তো ? কে বললে খারাপ ? যশোদা হাঁ করিয়া চাহিয়া থাকে, তিনটি যুবতি তৈরি করা চলিত এতগুলি হাড়মাংসের পুতুলের মতো। একটু বুঝি বিশ্বাস তার হয় কথাটাকে বড়ো সাধ কিনা বিশ্বাস করার। দেখিতে সে খারাপ নয়। এ কথা বিশ্বাস করিবার সাধ ছিল নাকি যশোদার ? হয়তো ছিল এতদিন খেয়াল করিয়াও খেয়াল করে নাই, খেয়াল করিতে সাহস পায় নাই। ধনঞ্জয় তাকে স্পষ্ট সুন্দরী বলিলে সে বোধ হয়। এই খেয়ালখুশির রসালো ফাঁদে পড়িত না, শুনিতে ভালো লাগা আলাদা কথা, সে মিঠা কথায় কাবু হওয়ার মানুষ যশোদা নয়, কিন্তু ধনঞ্জয় যেভাবে যা বলিয়াছে, সে কথাটা তো সত্য হওয়া আশ্চর্য নয়। তবু উঠিবার আগে ছড়া কাটিয়া রসিকতা করিতে যশোদা ছাড়িল না