পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র তৃতীয় খণ্ড.pdf/১৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ş\ხტby- মানিক রচনাসমগ্র যশোদা কিছুমাত্র বিচলিত না হইযা বলে, বলুক গে যাক, মবুক গে যাক, আজ তো নতুন নয়। ছেলেবেলা থেকে এমনি করে বলছে আমার নামে। তবে কী জান সরকারমশায়, আমার জন্যে এর সত্যি মায়া আছে। এমনি বলে মুখে, কিন্তু বাড়িতে যতই নিরীহ হইয়া থােক, যশোদার কাছে যতই কৌতুকের হাসি হাসুক, মেজাজ কিন্তু রাজেনের একেবারেই ঠান্ডা নয়। সুধীর কয়েকবার বোকার মতো প্রশ্ন করিলেই তার মেজাজ, গবাম হইয়া যায়। মনে থাকে না তোর নচ্ছার ? কবার বলব ? নাকের মাঝখানে আঁটা চশমার ভিতর দিয়া বাজেন হাতের খাতাটির বাদামি রঙের পাতায় চোখ বুলাইয়া বলে, তেইশটা। জায়গা থাকবে। থাকবে তো তোর কী ? তোর বাবার ওয়াগন ? নির্দোষ মন্তব্যের জবাবটা একটু কড়া হইয়া গিয়াছে ভাবিয়াই হয়তো রাজেন একটু মৃদু গলায় বলে, ছেচল্লিশটা বস্তা দুটাে ওযাগনে যাবে, তেইশ ভাগ হবে না রে পাঠা কোথাকার ! অ !—সুধীর তাড়াতাড়ি আর একবাব ওয়াগনের ভিতরে গিয়া বস্তাগুলি গুনিয়া ফেলে। আরও কয়েকটি ওয়াগনে একই সময়ে মাল বােঝাই হইতেছিল। চাট মোড়া, কাঠেব বাকসে প্যাক করা, চৌকো গোল ছােটাে বড়ো কত মাল এখানে আসিয়া জমা হইয়াছে, কাছে ও দূরে কত বিভিন্ন তাদেব গন্তব্যস্থান। প্রতিদিন রাশি রাশি মাল বাহিবে চলিয়া যায়, কিন্তু শহবের মালের ভান্ডার যেন অফুরন্ত। কথাটা ভাবিতে গেলে মাঝে মাঝে বিব্রত হইয়া সুধীরকে মাথা চুলকাইতে হয়, ব্যাপাবটা সে ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারে না। মাল যে কেবল এখান হইতে বাহিরে চলিযা যায় তা অবশ্য নয, ধূকিতে ধূকিতে ইঞ্জিন যে লম্বা ওয়াগনের সারি বাহির হইতে টানিয়া আনে সেগুলিও মালে বোঝাই থাকে, কিন্তু যে মাল বাহিরে যায়। তার সঙ্গে এই সব মালের তফাতটা অনায়াসেই সুধীর বুঝিতে পারে। একই বস্তা হয়তো ফিরিয়া আসে, ওয়াগনে তুলিবার সময় যে প্যাকিং কেসটির উপব সে পানেবা পিক ফেলিয়াছিল, কয়েকমাস পরে সেই পু্যাকিং কেসটিই হযতো অন্য এক ওয়াগন হইতে নামানো হয়, কিন্তু তবু সুধীর জানিতে পারে ভিতরের মাল বদলাইয়া গিয়াছে। কারণ—সুধীর এইভাবে মনেব মধ্যে যুক্তি খাড়া করে- যে জিনিস এখান হইতে দুশো-তিনশো মাইল দূরে চালান গিয়াছিল। সেই জিনিস কিছুকাল পরে আবার ফিরিয়া আসিবে কেন ? মানুষ তো পাগল নয় যে মিছিমিছি গাড়ি ভাড়া গুনিবে । সুধীরের শ্লথ অপরিণত মস্তিষ্ককে এই শহরের মাল আনাগোনার ব্যাপারটাব বিরাটত্ব সমুদ্র দর্শনার্থীর প্রথম সমুদ্র দর্শনের মতো একটা আয়ত্তাতীত বিস্ময় ও আনন্দে চিরদিন স্তম্ভিত ও মুগ্ধ করিয়া রাখিযাছে। এ সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা আছে, ব্যাপক ও বিচিত্ৰ। ভাবিতে গেলে তার মনে হয়, চিরটা জীবন সে বুঝি কেবল এই শহরের আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাজই করিয়া আসিয়াছে। জেটিতে সে কুলির কাজ করিয়াছে, চোখ মিটমিট করিতে করিতে চাহিয়া দেখিয়াছে, কেনের সাহায্যে বিদেশি জাহাজে মাল ওঠানো-নামানোর সশব্দ প্ৰক্ৰিয়া, ছোটোেবড়ো স্টিমাব আর পানসি নীেকোয় নিজে সে তাড়াহুড়া হইচই করিয়া মাল বোঝাই দিয়াছে, মাল নামাইয়া নিয়াছে, শহরতলির খালগুলির দুপাশে গুদাম ও আড়তে কাজ করিবার সময় নীেকায় ধীরেসুস্থে মাল আনা-নেওয়া দেখিয়াছে ; রেলের ইয়ার্ডে কাজ করার সময় দেখিয়াছে, মালগাড়ির আশ্রয়ে মালের দুমুখি স্রোত আর কাজের অবসরে শহরতলির প্রধান পথের ধারে দাঁড়াইয়া দেখিয়াছে, মাল বোঝাই লরি ও গোবু মহিষের গাড়ির আনাগোনা, ঝাঁকা ও মোট মাথায় মানুষের যাতায়াত। বিদেশে কী যায় বিদেশ হইতে কী আসে, মফস্বলে কী যায়, মফস্বল হইতে কী আসে সে সম্বন্ধে একটা অস্পষ্ট আবছা ধারণা সুধীরের আছে।