পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র তৃতীয় খণ্ড.pdf/১৮৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

> ケや মানিক রচনাসমগ্র সুধীর, মতির হইয়া যে মিলে মারামাবি করিয়াছিল, যশোদাকে কাল যে ডাক দিয়া বলিয়াছিল, চলো গো যশোদা, আমরা হাত ধরাধরি করে পিরিত করতে যাই ! সারাদিন সুধীরের পাত্তা মিলিল না, সারাদিন যশোদা তারই কথা উলটাইয়া পালটাইয়া মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করিতে লাগিল। একরাত্রেই যশোদার মন শাস্ত হইয়া গিয়াছে ; নিজের ভাবপ্রবণতার মেঘ কাটিয়া যাওয়ায় আর সুধীরেব মতো গৃহসুখে বঞ্চিত অশিক্ষিত বর্বর দুৰ্ভাগগুলির জন্য তার স্বাভাবিক মমতা ফিবিয়া আসায়, এবার ধীরে ধীরে সে সুধীরের পাগলামির মানে বুঝিতে পারে। কবে যেন সুধীর প্রথম টের পাইযাছিল, সংসারে টাকা বলো, রূপ-যৌবন বলো, দরদ ছাড়া সুখ নাই ? যশোদা যেদিন তাকে ভাত খাওয়ার সুযোগ দিতে ছল করিয়া বাড়ির বাহির হইয়া গিয়াছিল। সুতরাং দরদের দাম কষিতে তাকে শিখাইয়াছে। যশোদাই। আর মতি যেন কী বলিয়াছে সুধীরকে ? পরুিষের ভালোবাসা না পাওয়ায় মনটা বিগড়াইযা গিয়াছে যশোদার । যশোদার কাছে দরদ চিনিযা বৃপলাবণ্যের অভাবে পুরুষের ভালোবাসা না পাইয়া যশোদা মনে মনে কঁদিতেছে জানিয, সুধীরের পক্ষে এ কথা মনে কবা আশ্চর্য কী যে তার মতো জোয়ান বয়সি মানুষের ভালোবাসা পাইয়া যশোদা একেবারে কৃতাৰ্থ হইয়া যাইবে। স্বস্তি বোধ কবে যশোদা, মুখে একটু হাসিও তার দেখা দেয়। আহা, সুধীর তাঁধে। সত্যই দরদ দেখাইতেছিল ! হাতির মতো যে যশোদাকে কেউ চায় না, তাকে সঙ্গে করিয়া পলাইতে চাহিয়া সেই একটা মস্ত ত্যাগ স্বীকার করিতেছিল। তার আসল লোভ যে শ্ৰীমতী যশোদার উপর, সেই রোজগার করিয়া যশোদাকে খাওয়াইবে, এই কথাটায় যশোদাব বিশ্বাস জন্মানোর জন্য তাই আমন ব্যাকুল হইযা পড়িযাছিল সুধীর } রাত্রে রান্না করিতে করিতে যশোদা ভাবে, না, তার কুলিমজুরেরাই ভালো। এদের যদি আপন না করিবে, আপন হইবে করা ? সত্যপ্ৰিয়র মতো যারা বড়োলোক, অথবা জ্যোতির্ময়ের মতো যাবা ভদ্রলোক ? বড়োলোক, ভদ্রলোক আর ছোটোলোক, বিগড়াইয়া অবশ্য গিয়াছে সকলেই, তবু অভাবে যারা বিগড়াইয়া গিয়াছে তারা এখনও মানুষ আছে খানিক খানিক। আব্ব এ অবস্থায্য জীবন কাটাইয়। খানিক খানিক মানুষ থাকাও কী সহজ গৌরবের কথা ! সুধীরের মতো একজন করিয়া প্রত্যেক দিন তার সঙ্গে বেয়াদবি করুক, তবুও যশোদা চিরকাল এদেরই ভালোবাসিবে। সারাটা দিন বাহিরে কাটাইয়া রাত্রি প্রায় দশটার সময় সুধীর চুপিচুপি নিজের ঘরে গিয়া ঢুকিয়াছিল। যশোদা হাঁকিয়া বলিল, ও মতি, সুধীবকে ডাকো, ভাত খেযে যাক। সুধীরকে রান্নাঘরে খাইতে বসাইয়া যশোদা বলিল, এবারটি ধরলাম না তোমার কথা, আর কিন্তু ও সব বোলো না আমায় কোনোদিন। সুধীর মুখ নিচু করিয়া খাইতে থাকে, যশোদা পিঁড়িটা আর একটু সরাইয়া আনিয়া মুখোমুখি বসিয়া বলে, কাজে যাওনি আজ ? না । কাল থেকে যেয়ো । রান্নাঘরটি যশোদার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, কেবল তিনটি উনানের ধোঁয়ায় দেয়াল কালিবর্ণ হইয়া গিয়াছে। ধোঁয়ার সঙ্গে লড়াই করিয়া যশোদা পারে না। দোষটা অবশ্য আসলে ধোঁয়ার নয়, মানুষের পেটের। দু-বেলা ভাত সিদ্ধ করিতে না হইলে তিনটি উনানে দু-বেলা আঁচ দেওয়ারও দরকার হইত না, দেয়ালে এত কালিও জমিত না। ঘর-সংসার করার সাধ হয়ে থাকলে বিয়ে-থা করো একটা ? বলে তো আমিই না হয় বিয়েটা দিয়ে দিই তোমার একটা মেয়ে ঠিক করে ? সুধীর মাথা নাড়িয়া চুপচাপ খাইয়া যায়।