পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র তৃতীয় খণ্ড.pdf/২১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

br মানিক রচনাসমগ্রܠܹܓ বগলের লাঠি ফেলিয়া দিয়া ন্যাংচাইতে ন্যাংচাইতে কাছে আগাইয়া যায়, গায়ের নতুন আলোয়ানটি দিয়া রক্ত মুছিতে মুছিতে ব্যাকুলভাবে বলে, ডাক্তার ডেকে আনি ? আলোয়ানটি কড়িয়া নিয়া যশোদা বলে, ডাক্তার না হাতি ডাকবে। জল আনো এক ঘটি আর খানিকটা ন্যাকড়া। ধনঞ্জয় ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া পড়ে, এক পায়ে দুয়ারের কাছে গিয়া বগল-লাঠি তুলিয়া নিতে গিয়া হ্রমাড়ি খাইয়া পড়িয়া যাওয়ার উপক্ৰম করে। যশোদা ডাকিয়া বলে কুটাপুটি কোরো না বাবু, ধীরে সুস্থে আনো। রক্ত পড়ছে যে গো ! কই রক্ত পড়ছে ? টিপে ধরে আছি দেখছি না ? ধনঞ্জয় জল আর ন্যাকড়া আনিতে যায়, পায়ের পাতার ফুটা টিপিয়া ধরিয়া রাখিয়া যশোদা চাহিয়া থাকে উনুনের ভগ্নস্তুপের দিকে। একদিন দুবেলা এই উনুনে বিশ পঁচিশজনের রান্না করিত যশোদা, কুলিমজুরের মোটা ভাত, যশোদা যাদের আপনি করিতে গিয়াছিল। আজ তারা সকলেই তাকে ত্যাগ করিয়াছে, বাড়িতে তার মানুষ নাই। পরের বাড়ির একটা মেয়েকে চুবি করিয়া ভাইটা পর্যন্ত তার কোথায় উধাও হইয়া গিয়াছে। এদিকে ধনঞ্জয় চেঁচামেচি আরম্ভ করে, ও চাঁদের মা, ন্যাকড়া যে পাচ্ছি না ? ছোটো টিনের তেরঙ্গে ছেড়াকাপড় আছে একটা, সেইটে নিয়ে এসো। নির্দেশ দিয়া বলিয়া যশোদা চুপ করিয়া বসিয়া থাকে। টিনের তোরঙ্গটি যে চাবিবন্ধ আছে, ধনঞ্জয় খুলিতে পরিবে না, এ কথা তার মনে আছে। তবু সে আর সাড়াশব্দ দেয় না, পায়ের ক্ষত হইতে আঙুলের ছিপি খুলিয়া রক্তপাতের পথটাও মুক্ত করিয়া দেয়। এ একটা সাময়িক মানসিক বিলাস ভাঙা-মনের। নিজেকে আঘাত করিতেও সময় বিশেষে মানুষের বড়ো ভালো লাগে, নিজের দুলাল রক্তের অপচয়ও ভালো লাগে । কয়েকবার ডাকাডাকি করিয়া ধনঞ্জয়ও চুপ করিয়া যায়, খানিক পরে জলের ঘটি আর ছেড়া কাপড় হাতে করিয়া আসিয়া যশোদার কাণ্ড দেখিয়া আবার ব্যাকুল হইয়া পড়ে। টিপে ধরো, টিপে ধরো, শিগগির টিপে ধরে। যশোদা করুণভাবে একটু হাসিয়া বলে, কী করে খুললে বাসকো ? টেনে খুলেছি। তার মানে বাসকোর তালাটি ভেঙেছে আমার। ধন্য তুমি। পায়ে একটা লোহার শিক বিধিয়া যাওয়া বাধা হিসাবে গণ্য করিবার মতো গুরুতর ব্যাপাব। কিছু নয়। বাড়ি ছাড়িয়া যাওয়ার আর সব ব্যবস্থাই যখন হইয়া গিয়াছে, বাড়িটা বিক্ৰয় করিতে পর্যন্ত বাকি আছে, কেবল হাতে টাকাটা পাইয়া দলিল রেজেস্ট্রি করা, ভারী ভারী জিনিসপত্র প্রায় সমস্তই পাঠাইয়া দেওয়া হইয়াছে শহরের অপর প্রাস্তের আরেক শহরতলির ভাড়াটে বাড়িতে, রওনা হওয়ার আয়োজন শেষ, শুধু বাকি আছে গাড়ি ডাকিয়া বাকি জিনিসপত্র নিয়া গাড়িতে উঠিয়া বসার, তখন পায়ে শিক বেঁধাকে উপলক্ষ করিয়া হঠাৎ বঁকিয়া বসার কোনো অর্থ হয় না। যে সব কারণে যশোদা এ বাড়ি ছাড়িয়া এদিকের শহরতলি ছাড়িয়া জন্মের মতো চলিয়া যাইতেছিল, পা একটু জখম হওয়ায় তার একটিও বাতিল হইয়া যায় নাই। তবু শেষ মুহূর্তে যশোদা ওই ছুতায় যাওয়াটাই বাতিল করিয়া দিল। ধনঞ্জয় বলিল, এ পা নিয়ে যেতে তোমার কষ্ট হবে চাঁদের মা ! যশোদা চুপ করিয়া রহিল। তার এই গান্তীর্য ধনঞ্জয়ের কাছে চিরদিন বড়ো অস্বস্তিকর। একটু ভয়ে ভয়ে যে বলিল, খুব ব্যথা করছে তো ? যশোদা ফোস করিয়া উঠিল, কীসের ব্যথা ? আমার আবার ব্যথা-বেদনা কীসের শুনি ?