পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র তৃতীয় খণ্ড.pdf/২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ S সুবলের কী শাস্তি হয় দেখিবার জন্য সরসী ব্যগ্র হইয়া রহিল, কিন্তু সুবলের কিছুই হইল না। সুবলের বাবাকে ব্যাপারটা জানাইয়া দিবার পরামর্শ পর্যন্ত মার যুক্তিতর্কে বাতিল হইয়া গেল। সরসীর প্রতিই শাসনের অবধি রহিল না। আপনজন যেই বাড়ি আসিল সকলেব কাছে একবার করিয়া ব্যাপারটার ইতিহাস বলিয়া তাকে লজ্জা দেওয়া হইতে লাগিল। এ বাড়িতে দুজনকে চুপিচুপি কথা বলিতে দেখিলেই সরসী বুঝিতে পারে, তার কথাই আলোচিত হইতেছে। নিদারুণ কড়াকড়ির মধ্যে পড়িয়া কয়েক দিনের মধ্যেই সরসী হাঁপাইয়া উঠিল। সময়ে শাসনও একটু শিথিল হইল, সরসীরও সহ্য হইয়া গেল, কিন্তু মনে মনে সে এমন ভীরু হইয়া পড়িল বলিবার নয়। ছেলেবেলা হইতে চেনা ছেলেবা বাড়িতে আসিলে একা তাদের সঙ্গে কথা বলিতে সরাসীর ভয় করিতে লাগিল। লোকে দোষ দিবে, ভাবিবে, কী জানি মনে ওর কী আছে! এক পাশের বাড়ি যাওয়ার সাহস পর্যন্ত সে হারাইয়া ফেলিল। দুপুব বেলা সে মার কাছে শুইয়া থাকে, ঘুম আসে না, অন্যঘরে গিয়া একটু একা থাকিতে ইচ্ছা কবে, তবু সে শুইযা থাকে। কোথায্য গিয়াছিল। জিজ্ঞাসা করিলে সে যদি বলে যে বাড়িতেই ছিল, পাশের ঘবে ছিল, কোথাও যায় নাই, মা হযতো সে কথা বিশ্বাস করিবে না। সংসারের আর সমস্ত মেয়ের মতো সে নয়, কুমাবীধর্ম বজায় বাখার জন্য তার ওদের মতো যথেষ্ট ও প্রাণপণ চেষ্টা নাই ; সকলের মনে এমনই একটা ধারণা জন্মিয়াছে জানিয়া সরাসী দিবারাঞি সজ্ঞানে নিজের চলাফেরা নিয়ন্ত্রিত করিতে লাগিল। সকলের চুরি চুরি খেলার মধ্যে চুরি না করিয়াও বেচারি হইয়া রহিল চোর। উপদেশ শুনিল : মেয়েমানুষের জীবনে আর কাজ কী মা ? চাদিকে পুরুষ গুন্ডা হাঁ করে আছে, পা পিছলে না। ওদের খপ্পরে পড়তে হয়,-বাস এইটুকু সামলে চলা। ছড়া শুনিল । পুড়ল মেয়ে উড়ল ছাই, তবে মেয়েব গুণ গাই । শুনিয়া শুনিয়া সরাসীর ভয় বাড়িয়া গেল। সংসারের নারী-সংক্রাস্ত নিয়মগুলি এখন সে মোটামুটি বুঝিতে পারে। ধরিযা নেওয়া হইয়াছে যে খারাপ হওয়াটাই প্রত্যেক মেয়ের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি ; মেয়েদেব খারাপ না হওযাটািই আশ্চর্য। এই আশ্চৰ্য্য কাজটা করাই নারী জীবনের একমাত্র তপস্যা। সাবধানী হইতে হইতে সরসী ক্ৰমে ক্ৰমে অতি সাবধানী হুইয়া গেল। ভালো হইয়া থাকাটা তার কাছে আর ব্যক্তিগত ভালোমন্দ বিবেচনার অন্তর্গত হইয়া রহিল না। সকলে চায় শুধু এই জনাই নারীধর্ম পালন করিয়া যাওয়ার জন্য নিজেকে সে বিশেষ ভাবে প্রস্তুত করিয়া নিল । তারপব, যোলো বৎসর বয়স পূর্ণ হওয়ার কয়েক মাস আগে রাসবিহারীর সঙ্গে সরসীর বিবাহ হইয়া গেল । বলা বাহুল্য, রাসবিহারী কেরানি। বলা বাহূল্য এই জন্য যে সরসী মধ্যবিত্ত গৃহস্থ পরিবারের মেয়ে, বরাবর গায়ে থাকার জন্য খানিকটা গেয়ো আর কথামালা পড়া বিদ্যা’। লুকাইয়া নভেল পড়ার জন্য একটু শহুরে, অসামান্য অঙ্গসৌষ্ঠবের জন্য তার শুধু স্বাস্থ্য ভালো এবং গায়ের রঙের জন্য সে একটু মূল্যবতী। কেরানি ছাড়া এ সব মেয়ের বর হয় না। রাসবিহারীর মাহিনা যে এখন একশোর কাছে এবং একদিন দুশোর কাছে পেঁৗছানাের সম্পভাবনা আছে, সে শুধু সরসীর ওই রংটুকুর কল্যাণে। রাসবিহারীর সাইজ মাঝারি, চেহারা মাঝারি, বিদ্যা মাঝারি, বুদ্ধি মাঝারি। যাকে বলে মধ্যবতী, তাই। সরাসীকেও সে মাঝারি নিয়মে ভালোবাসিল, কখনও মাথায় তুলিল, কখনও বুকে নিল, কখনও