পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র তৃতীয় খণ্ড.pdf/৩০০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Soo S. মানিক রচনাসমগ্ৰ সমস্যা। সর্বস্ব ত্যাগ করিতে পারে, জীবন বিসর্জন দিতে পারে, এত বড়ো ভক্তই যদি মহেশ চৌধুরি হয়, সদানন্দ তাকে আমল দেয় না কেন, কেন তাকে শিষ্য করে না ? এই সমস্যা আজ বহুদিন সকলকে পীড়া দিতেছে, এ বিষয়ে নিজেদের মধ্যে তারা অনেক আলোচনা করিয়াছে, মনে মনে অনেক মাথা ঘামাইয়াছে। কারও কারও মনে এ সন্দেহও জাগিয়াছে যে, মানুষটা মহেশ চৌধুবি কি আসলে তবে ভালো নয়, তার নীতি ধর্ম ভক্তি নিষ্ঠা সব লোক দেখানো ভালোমানুষি ? মহেশ চৌধুরি উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলে, যাই, একবার ঘুরে আসি আশ্রম থেকে। কয়েকজন কৌতুহলভারে তার সঙ্গ নিলে সে তাদের ফিরাইয়া দেয়, বলে, না, আজ আব তোমাদের গিয়ে কাজ নেই ভাই। প্ৰভু যখন বারণ করে দিয়েছেন, মিছিমিছি গোলমাল না করাই उछ्व् । আশ্রমে গিয়া মহেশ চৌধুরি যাকে সামনে পাইল তাকেই প্ৰভুব চরণ দর্শনের জন্য ব্যাকুলভাবে আবেদন জানাইতে লাগিল। কেউ জবাব দিল, কেউ দিল না। তখন মহেশ চৌধুরি গিয়া ধরিল বিপিনকে । বিপিন বলিল, সাতদিন পরে আসবেন। মহেশ চৌধুরি মিনতি করিয়া বলিল, আপনি একবার প্রভুকে গিযে বলুন, প্ৰভুব জন্য আমি সর্বস্ব ত্যাগ করব, জীবন বিসর্জন দেব। আপনি বললেই প্ৰভু আমায ডেকে পাঠাবেন। বিপিন রাগিয়া বলিল, কে আপনাকে সর্বস্ব ত্যাগ করতে, জীবন বিসর্জন দিতে সোধেছে মশায় ? কেন আসেন। আপনি আশ্রমে ? যান যান, বেরিয়ে যান আমার আশ্রম থেকে। কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া মহেশ চৌধুরি ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরিয়া গেল। ফিবিয়া আসিল শেষ রাত্রে । সদানন্দের সদবের কুটিবের সামনে কদম গাছটাৰ তলায় বসিযা পড়িল। কুটিবের আড়াল হইতে সূর্য উঠিলেন মাথাৰ উপবে, তারপর আকাশ ঢাকিযা মেঘ করি যা আসিযা ঘণ্টাখানেক বৃষ্টি হইয়া গেল, তারপর আবার কড়া রোদ ঢালিতে ঢালিতে সূর্য আড়াল হইলেন অন্য একটি কুটিবোৰ আড়ালে, গাছতলা হইতে মহেশ নড়িল না। রোদে পুড়িয়া জলে ভিজিযা খাওয়া ছাড়িয়া কী তপস্যা করিতে বসিয়াছে গাছতলায় ? এত জায়গা থাকিতে এখানে তপস্যা করিতে বসা কেন ? আশ্রমের সকলে সম্মুখ দিয়া যাওয়ার সময় বিস্ময় ও কৌতুহলভরা দৃষ্টিতে তাকে দেখিতে থাকে,- তাকে দেখিবার জন্য কেউ আসে না বটে। কিন্তু এদিক দিয়া যাতায়াত করার প্রয়োজন আজ যেন সকলের বাড়িয়া যায়। বেলা বাড়িলে তিন-চারবার মহেশ চৌধুরির বাড়ি হইতে লোক আসিয়া ফিরিয়া গিয়াছিল। বর্ষণের আগে আসিয়াছিল। কেবল চাকর গোমস্তা, বর্ষণের পর আসিল মহেশের ভাগনে শশধর । গাছতলায় মাটিতে উপবিষ্ট মামার জলে ভেজা মূর্তি দেখিয়া বেচারা কঁাদিয়া ফেলে। আর কী ! কিন্তু সেও মহেশের তপস্যা ভঙ্গ করিতে পারিল না। তবে দেখা গেল ছেলেটার বুদ্ধি আছে। নিজে হার মানিয়া সে ফিরিয়া গেল বটে, কিন্তু বিকালবেলা হাজির হইল একেবারে মামিকে সঙ্গে করিয়া। ভাগনে কেবল কঁাদিয়া ফেলার উপক্ৰম করিয়াছিল, স্বামীর অবস্থা দেখিয়া স্ত্রী কঁাদিয়াই আকুল। কেন তার মরণ হয় না ? যার স্বামী পাগল, ছেলে পাগল, সে কেন সংসারে বঁচিয়া থাকে নিত্যনতুন যন্ত্রণা সহ্য করিতে ? কঁদিতে কঁাদিতে হাতের বালা দিয়া বিভূতির মা কপালে আঘাত করিল। রক্ত বাহির হইল একটু-ডান চোখের জলের ধারাটা লাল হইয়া গেল। মহেশ চৌধুরি কাতরভাবে বলিল, শোনো শোনো, আহা এমন করছ, কেন ? বাড়ি ফিরে যাও, আমি ঠিক সময়ে যাব।