পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র তৃতীয় খণ্ড.pdf/৩০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

অহিংসা \C ; দেখানো হচ্ছে-স্বামীর একটা কথা শুনবে না, স্বামীভক্তি দেখাতে গাছতলায় এসে ভেজা চাই। কী অদ্ভুত সতী রে আমার ! স্বামীর শাস্তি নষ্ট করে সতীত্ব ফলানো ! বৃষ্টি আর বাতাস দুয়েরই বেগ বাড়িতে থাকে। মহেশ চৌধুরিব রাগ আব্ব জ্বালাবোধ কিন্তু না বাড়িয়া এই সামান্য ভণ্ডািসনার মধ্যেই একেবারে ক্ষয় হইয়া যায়। আরও অনেকক্ষণ জোর টানিতে পারিত, বলিতে পারিত আরও অনেক কথা, কিন্তু কিছু না বলিয়া একেবারে চুপ হইয়া গেল। অন্ধকারে এত কাছাকাছি বসিয়াও কেহ কারও মুখ দেখিতে পাইতেছে না। গাঢ় অন্ধকারে শুধু একটি আলোর বিন্দু চােখে পড়ে। কিছুদূরের একটি কুটিরে কে যেন একটি আলো জুলিয়া জানালা খুলিয়া রাখিয়াছে। জাগিয়া আছে না ঘুমাইয়া পড়িয়াছে মানুষটা কে জানে ! এত রাত্রে চোখে ঘুম নাই। এমন শাস্তিহীন অভাগা কে আছে সাধু সদানন্দের আশ্রমে ? সদানন্দের যে শিষ্য, সদানন্দের আশ্রমের কুটিরে যে বাস করিবার অধিকার পায়, জীবনের সব জ্বালাপোড়ার ছোঁয়াচ তো সঙ্গে সঙ্গে তার মন হইতে মুছিয়া যাইবে, সন্ধ্যার সঙ্গে শিশুর মতো দু-চােখ ভারী হইয়া আসিবে শিশুর চোখের ঘুমে ? আলোর বিন্দুটি নিভিয়া গেলে মহেশ চৌধুরি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। তাই বটে। কোনো দরকারে কেউ আলো জুলিয়া রাখিয়াছিল-ঘুম আসিতেছিল না বলিয়া নয়, মনের আগুন রাত্রি জাগরণের অবসাদে চাপা দিবার দরকার হইয়াছিল বলিয়া নয। দুই হাত জড়ো করিয়া মহেশ চৌধুরি মনে মনে সদানন্দের চরণে মাথা লুটাইয়া প্ৰণাম করে। হে মহেশ চৌধুরির জীবন্ত দেবতা, মহেশ চৌধুরির কল্যাণের জন্যই তুমি তাকে অবহেলা করিয়া দূরে ঠেলিয়া রাখ, দুঃখের আগুনে পুড়িয়া মহেশ চৌধুরির মন যেদিন নির্মল হইবে সেই দিন পয়ে ঠাই দিয়া মহেশ চৌধুরির সমস্ত দুঃখ দূর করিয়া তাকে তুমি শাস্তি দিবে, এ কথা জানিতে কী বাকি আছে মহেশ চৌধুরির। এই ধৈর্যের পরীক্ষায় শিষ্য না করিয়াও শিষ্যের মতোই তাকে যে প্রকাবান্তরে আত্মশুদ্ধির কঠোর সাধনায় নিযুক্ত করিয়াছ, সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভের জন্য মহেশ চৌধুরি জীবন দিতে প্ৰস্তুত আছে। কিন্তু আজ এই বিপদে তুমি তাকে রক্ষণ করো। তুমি কি দেখিতে পাইতেছ। না প্ৰভু, মহেশ চৌধুরিকে ফিরাইয়া নেওয়ার জন্য, মহেশ চৌধুরির সাধনা ব্যর্থ করার জন্য একজন ভিজিতেছে ? স্ত্রী বলিয়া নয়, ছেলের মা বলিয়া নয়, একজন স্ত্রীলোকের এত কষ্ট চোখে দেখিয়া স্থির থাকার মতো মনের জোর যে মহেশ চৌধুরির নাই প্ৰভু। সদানন্দ অবশ্য তখন ঘুমাইতেছিল। আজ বেশ ঠান্ডা পড়িয়াছে। কিন্তু জানা থাকিলেও মহেশ চৌধুরির কিছু আসিয়া যাইত না। পাথরের দেবতার কাছেও মানুষ প্রার্থনা জানায-ঘুমন্ত মানুষ তো জীবন্ত। নব্য কি ? পরদিন চারিদিকে খবর ছড়াইয়া গেল মহেশ চৌধুরি সস্ত্রীক সাধুবাবার আশ্রমে ধন্না দিয়াছে। চারিদিক মহেশ চৌধুরির দর্শনপ্রার্থী। শেষরাত্রে বৃষ্টি বন্ধ হইয়া গিয়াছিল, সকালবেলা ভিজা পৃথিবীতে সোনালি রোদ উঠিয়াছে। মহেশ চৌধুরি ও তার স্ত্রী দুজনের গায়ে রোদ পড়িয়া দেখাইতেছে যেন মূর্তি-ধরা বিশৃঙ্খলা ও অবাধ্যতা কিন্তু অপার্থিব জ্যোতি দিয়া আবৃত। দুজনের গায়ে আবরণের মতো পড়িবে বলিয়া রোদের রংটা আজ বেশি গাঢ় হইয়াছে নাকি ? রত্নাবলী ও উমা আসিয়াছিল। সকলের আগে, রোদ উঠিবারও আগে। রত্নাবলী চোখ বড়ো করিয়া বলিয়াছিল, সমস্ত রাত এখানে ছিলেন ? মহেশ চৌধুরি বলিয়াছিল, থাকবার জন্যেই তো এসেছি মা। মহেশ চৌধুরির কথা বলিবার ধরন পর্যন্ত যেন একরাত্রে বদলাইয়া গিয়াছে।