পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র তৃতীয় খণ্ড.pdf/৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

wer মানিক রচনাসমগ্র ঘুরিয়াও ভালোমতো বাতাস সৃষ্টি করিতে পারিতেছিল না। শুধু টেবিলে খোলা প্যােডটার পাতাগুলিকে অস্থির করিয়া তুলিয়াছিল। অমলা নালিশ করিল, সন্ধে থেকে মেঘ করেছে, এখনও বিষ্টি নামিল না, নামলে বাঁচি । মেঘ করেছে নাকি ? টের পাওনি ? কবার যে বিদ্যুৎ চমকাল, মেঘ ডাকল ? সূৰ্যকান্ত এক নতুন দৃষ্টিতে অমলাকে দেখিতেছিল, পরীক্ষার সময় ছেলেদের প্রথম প্রশ্নপত্ৰ দেখার মতো। তারপর একটা প্রশ্নেরও জবাব-না-জানা ছেলের মতো সে বলিল, সন্ধ্যা থেকে গল্প লিখবার চেষ্টা করছিলাম অমল। সত্যি ? নতুন গল্প ! দেখি তো কতটা লিখলে ?--অমলা তাড়াতাড়ি টেবিলের কাছে গেল, কাগজ-চাপাটার তলে একটিও লেখা কাগজ না দেখিয়া সে আশ্চর্য হইয়া গেল। প্যাডটার প্রথম পাতায় শুধু হেডিং, সূৰ্যকাস্তের নাম আর পাঁচ-ছলাইন লেখা। সন্ধ্যা থেকে শুধু এইটুকু লিখেছি। ! সূৰ্য্যকাস্ত ধপাস করিয়া বিছানায় বসিয়া বলিল, না, অনেক লিখেছি। ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটটাতে পাবে। আমলা সবিস্ময়ে বলিল, ওমা, ছেড়া কাগজে যে ভর্তি ! সব আজকে লিখে লিখে ছিড়েছু ? সায় দিয়া সূৰ্য্যকান্ত একটা হাই তুলিল। শ্রান্তি ? আমলা তাড়াতাড়ি কাছে আসিয়া বলিল, ঘুম পেয়েছে? ঘুমোও। তবে। দাঁড়াও বালিশটা ঠিক কবে দি। সূৰ্যকান্ত বলিল, না, ঘুমোব না। এক মাসের মধ্যে এক লাইন লিখতে পারলাম না—ঘুমোব । শুধু আজ ? কতদিন ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটটা এমনিভাবে ভর্তি করেছি। তার ঠিক নেই। তুমি আমাকে কী করে দিয়ে গিয়েছ তুমিই জানো, লিখতে বসতেও আর ইচ্ছে করে না, বসলেও মন বসে না, জোর করে যা লিখি সব ছিড়ে ফেলে দিই ! উপন্যাসের ইনস্টলমেন্টটা পর্যন্ত লিখে দিতে পারিনি। সূৰ্যকান্তের বিষন্ন মুখ দেখিলে কষ্ট হয়। অমলার বুকের মধ্যে টিপটপ করিতেছিল, দুচােখ বড়ো বড়ো করিয়া সে চাহিয়া রহিল। বিবাহিত জীবনের এই পরিচিত আবেষ্টনীর মধ্যে ফিরিয়া আসিয়া বাপের বাড়ি হইতে সংগ্ৰহ কবিয়া আনা সহজ ও শাস্ত ভাবটুকু অমলার ঘুচিয়া যাইতেছিল। এ ঘরের আবহাওয়ায় সে এক যত বিদ্যুৎ ঠাসিয়া রাখিয়া গিয়াছিল তার দেহমান যেন আবার তাহা শুযিয়া লইতেছে। তবু এবার হয়তো একটু সংযত থাকিতে পারিত অমলা, হয়তো সূৰ্যকান্ত যে রকম চাহিয়াছিল সেই রকম হওয়ার জন্য চেষ্টা করিতে পারিত-সূৰ্য্যকান্ত যদি এমন ভাব না দেখাইত আজ, এমনভাবে কথা না বলিত। তাব সুদীর্ঘ কুমারী জীবনের শেষ ক-মাসের কল্পনার মতো হইয়া উঠিয়াছে যে সূৰ্যকান্ত আজ ! আঙুল চালাইয়া চালাইয়া চুল এলোমেলো করিয়া দেওয়ায় কী বন্যই আজ তাকে দেখাইতেছে ! চোখের চাহনিতে যেন বিপন্নতার সঙ্গে মিশিয়া আছে বিদ্রোহ, কথা বলিবার ভঙ্গিতে যেন শোনা যাইতেছে পরাজিত ক্ষুব্ধ আত্মার নালিশ, বসিবার ভঙ্গি দেখিয়া মনে হইতেছে হঠাৎ উঠিয়া ভয়ানক কিছু করিবার এটা ভূমিকা মাত্র। তাছাড়া, তারই জন্য একমাস সূৰ্য্যকাস্ত কিছুই লিখিতে পারে নাই ! প্রথম দীর্ঘ বিরহ আসিবামাত্র স্বামী তার বুঝিতে পারিয়াছে, কী ভয়ানক ভালোই সে বাসিয়া ফেলিয়াছে তার বউকে ! আমলা শিহরিয়া ওঠে, তার রোমাঞ্চ হয়। গদগদ কণ্ঠে সে বলিল, আমার জন্য ? আমার জন্য এক মাস তুমি লিখতে পারনি ? সূৰ্যকান্ত তার হাত চাপিয়া ধরিল। এত জোরে ধরিল যে চুড়িগুলি প্রায় কাটিয়া বসিয়া গেল অমলার হাতে। গলা আবেগে কাঁপাইয়া সূৰ্যকাস্ত বলিল, কার জন্য। তবে ? তুমি আমায় পাগল করে দিয়েছ, আমল, আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছ। কতবার ইচ্ছে হয়েছে ছুটে গিয়ে তোমাকে দেখে আসি। কেন। যাইনি জানো ? বিরহের যাতনা কত তীব্র হতে পারে। তাই দেখবার জন্য। আমার