পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র তৃতীয় খণ্ড.pdf/৩৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

wo মানিক রচনাসমগ্র আনিয়াছিল। কেবল আজ নয়, আগের দুদিনও আনিয়াছিল। মারামাবিটা যে আজ হঠাৎ লাগে নাই, এ তার একটা মস্ত বড়ো প্ৰমাণ। শেষ পর্যন্ত বিভূতির স্থাপিত ব্যায়াম সমিতিগুলির সদস্যেরা আসিয়া সেদিনকার মতো সেখানকার হাঙ্গামাটা থামাইয়া দিল। মারামারিটা হইতেছিল এক গ্রামের লোকের সঙ্গে আর এক গ্রামের লোকের এবং বিভূতি ব্যায়াম সমিতি স্থাপন করিয়াছিল এক এক গ্রামে একটা করিয়া। কিন্তু এমনই আশ্চর্য ব্যাপার, মারামারিটা বন্ধ করিল ভিন্ন ভিন্ন গ্রামের ব্যায়াম সমিতিগুলির সদস্যেবা একসঙ্গে মিলিয়া। অধিকাংশই মাথা-গরম যুবক কিন্তু তাদের মধ্যে এমন ঘোরতর মিল দেখা গেল ঠান্ডমাথা বুড়োদের মধ্যে যা সম্ভব হয় না। আহত বিভূতিকে তারা গোবুর গাড়িতে বাড়ি পাঠাইয়া দিল। বিভূতির আঘাত বিশেষ গুরুতর নয়, অন্তত দেহের আঘাত নয়। অন্যান্য যারা আহত হইয়াছিল তাদের কয়েকজনকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হইল। কিন্তু অধিকাংশ আহত মানুষ যে কোথায় উধাও হইয়া গেল তার আর কোনো পাত্তাই মিলিল না। মারামারি কিন্তু সেইখানে শেষ হইল না। এক গ্রামের কয়েকজন অন্য গ্রামের একজনকে এক পাইলে ধবিয়া পিটাইয়া দিতে লাগিল । মারামাবির পরদিন সকালে নন্দনপুরে গিয়া মহেশ চৌধুরি মারা খাইয়া অজ্ঞান হইযা গেল। মাথাটা তার ফাটিয়া গেল এবং দাঁত ভাঙিয়া গোল কয়েকটা । বিভূতি আহত অবস্থায় বাড়ি ফিরিলে মহেশ চৌধুরি জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, তুমি গিয়ে দাঙ্গা করে এসেছ ? বিভূতি বলিয়াছিল, না। যাতে দাঙ্গা না বাধে তার চেষ্টা করেছিলাম। কথাটা মহেশ বিশ্বাস করে নাই, কিন্তু তখনকার মতো কিছু আর বলেও নাই। পরদিন সকাল হইতে না হইতে আসল ব্যাপারটা জানিবার জন্য নিজে ছুটিয়া গিয়াছিল। কিন্তু খোঁজখবব নেওয়াব সুযোগটাও সে পায় নাই! তাকে দেখিয়াই নন্দনপুরের জনপাঁচেক বদমেজাজি মানুষ বলিয়াছিল ; বিভূতুির বাপ-ব্যাটা এসেছে বো । বলিয়াই তাকে পিটাইতে আরম্ভ করিয়াছিল। অনেক বেলায় খবর পাইয়া বিভূতি তাকে আনিতে গেল। বাপের অবস্থা দেখিয়া মুখ তার অন্ধকার হইয়া গেল। যাদের সে যাচিয়া আগের দিন যাত্রার আসরে সঙ্গে নিয়া গিয়াছিল, মারামারির জন্য তাদের উপরেও তার বিরক্তির এতক্ষণ সীমা ছিল না। এ রকম একটা কুৎসিত কাণ্ড ঘটার জন্য মনে মনে তার বড়োই খারাপ লাগিতেছিল। সে ভাবিতেছিল, এই রকম বর্বর যদি তার দেশের মানুষ হয়। আর এই রকম কারণে অকারণে পরস্পরকে হিংসা করে আর পরস্পরের সঙ্গে কলহ বাধায়, দেশের তবে হইবে কী ? আজি আহত বাপকে দেখিয়া সর্বাগ্রে তার মনে হইল, যারা তার ব্যাপকে এ ভাবে মারিয়াছে, তাদের কিছু উত্তম মধ্যম না দিলে জীবনধারণ করাই বৃথা। কিন্তু কে যে মহেশ চৌধুরিকে মারিয়াছে, কেউ তা জানে না। অত সকালে আটচালার দিকে বড়ো কেউ যায় নাই। একটু বেলায় মহেশকে রাস্তায় পড়িয়া থাকিতে দেখিয়া গ্রামে একটা গোলমাল বাধিয়া যায়। তখন নন্দনপুর ব্যায়াম সমিতির সদস্যেরা তাকে সযত্নে তুলিয়া আনিয়া সেবাযত্নের ব্যবস্থা করিয়াছে। ডাক্তার দেখাইয়া পালকিতে করিয়া মহেশকে বাড়ি নিয়া যাওয়া হইল। সারাদিন সারারাত বিভুতি মহেশের শিয়রে বসিয়া রহিল, বিভূতির মা বসিয়া রহিল পায়ের কাছে। মাধবীলতাও ওই রকমভাবেই রাতটা কাটাইবার আয়োজন করিয়াছিল, বিভূতির জন্য পারিয়া উঠিল না। মাঝরাত্রে বিভূতি তাকে এমন একটা অপমানজনক ধমক দিয়া ন্যাকামি করিতে বারণ করিয়া দিল যে কাদিয়া ফেলিয়া মাধবীলতা উঠিয়া গেল।