পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র তৃতীয় খণ্ড.pdf/৪১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ধরাবাধা জীবন 8>○ ভূপেন বলিল, দুজনেই অজ্ঞান হয়ে পড়ল। কিনা— প্ৰভা বলিল, ও রকম যাবা কথায় কথায় অজ্ঞান হয়, তাদের গায়ে বালতি বালতি জল ঢেলে দিতে হয়। আমি ওরা কী চিকিৎসা করব ! ভূপেন নিচু গলায় আদর করিয়া বলিল, তুমি রাগ করেছ প্ৰভা ? প্রভার বোধ হয় মনে পড়িযা গেল এই মানুষটার সম্প্রতি ছেলে আবা বউ মারা গিয়াছে। সেও এবার শাস্ত গলায় বলিল, না, রাগ করিনি। বড়ো ঘুম পেয়েছে কিনা- ፳ এখানেই ঘুমিয়ে থাকো ? এ প্রস্তাবে প্ৰভা বাজি হইল না। নিজের বিছানাটি ছাড়া তার ঘুম আসে না। তা ছাড়া কাল ভোর হইতে না হইতে রোগী আসা আরম্ভ হইবে। তখন ভূপেন বলিল, চলো। তবে তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। প্রভা বলিল, উজু, রাত একটার সময় আপনি আমায় অতদূরে পৌঁছে দিতে যাবেন, তার কোনো মানে হয় না। ফিরতে ফিরতে আপনার আড়াইটে তিনটে বেজে যাবে। কাল বোধ হয় সারারাত ঘুমোননি--- সঙ্গে যে দাসী আসিয়াছিল তার সঙ্গেই প্ৰভা ফিরিয়া গেল । এমনিভাবে প্রভার সঙ্গে ভূপেনের একদিনে তিনবার দেখা হইয়া গেল, ছেলে আব্ব বউয়ের শোকের প্রথম ধাক্কায় সে যখন কাবু হইয়া পড়িয়াছে। তারপর প্রভার সঙ্গে দু-একদিন আস্তর দেখা হইতে থাকে, দিন কাটিতে কাটিতে মাস কাটিয়া যায়। ভূপেন স্পষ্ট করিয়া প্রভাকে কিছু বলে না, ধৈর্য ধরিয়া অপেক্ষা করিয়া থাকে। ভাবে, কিছুদিন চুপ কবিয়া থাকাই উচিত। ছেলে বউ মারা যাওযার পর সময় কাটিতে না দিযা প্রভাকে বলা সঙ্গত হইবে না যে এবার তুমি আমার বউ হও প্ৰভা । কেবল এই জন্যই যে ভূপেন চুপ করিয়া থাকে তা নয়। ছেলে আর বউয্যের শোকটাই তাকে বাধা দেয়। ভূপেন কঁদে না, কিন্তু ভাবে। প্রায় সব সময়েই ভুলবে। চােখ বুজিয়া ভাবিতে ভাবিতে কখনও সরমাকে কখনও নাস্তুকে চোখের সামনে দেখিতে পায়, ওদের চোখের মুখের হাতের পায়ের চুলের দাঁতের এক একটি বৈশিষ্ট্য হঠাৎ এক সময় স্পষ্ট হইয়া ওঠে। ওদের হাসিকান্নার মুখভঙ্গি মনে করিতে গিয শব্দ পর্যন্ত শুনিতে পাইয়া দু-একবার ভূপেন চমকাইয়া পর্যন্ত ওঠে। সবামার বাকসো আলমারি ঘাঁটিতে ভূপেনের ভালো লাগে। মাঝে মাঝে দরজা বন্ধ করিয়া ঘণ্টাব পর ঘণ্টা ওই খেলাতেই সে মাতিয়া থাকে। কত বিচিত্ৰ কাপড়-জামাই সরমার ছিল প্রসাধনের কত বিভিন্ন সামগ্ৰী ! গাযে আঁটে না এত সোনাব গয়না ছিল, তবু বাঁশি রাশি কাচের চুড়ি জমা করা আছে দেখিয়া ভূপেন যেন আশ্চর্য হইয়া যায়, নতুন করিয়া আজ যেন সে বুঝিতে পারে কী ছেলেমানুষই ছিল তার সারমা। দুটি দামি কাপড়ের ভঁাজে খানিকটা আচার পাওয়া যায়। সারমার চুরি করিয়া আচার খাওয়ার শখ ছিল, কলে ধরা পড়িবার ভয়ে এখানে আচার গুজিয়া দিয়াছিল তারপর আর মনে ছিল না ! তিন শিশি ওষুধ একটি বাকসের তলে লুকানো অবস্থায় পাওয়া যায় মাস ছয়েক আগে সরমাকে শরীর ভালো করার জন্য ওষুধ দেওয়া হইয়াছিল। এতদিন পরে আজ্ঞ ভূপেন টের পায় ওষুধ সরমা খাইত না, তাকে ফাঁকি দিয়াছিল। দুষ্টামিও কী কম জানিত তার সরমা অজস্র স্মৃতিচিহ্নের মধ্যে সরমা তার স্মৃতি আর পরিচয় রাখিয়া গিয়াছে। বাকসোটি খোলামাত্র যে গন্ধ নাকে লাগে তাও যেন সরমারই একটা ঘনিষ্ঠ স্থায়ী অস্তিত্ব। ভূপেন জোরে শ্বাস টানে