পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র তৃতীয় খণ্ড.pdf/৪৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ধরাবাঁধা জীবন 8○ a যতক্ষণ প্ৰভা সামনে বসিয়া কথা বলিতেছিল প্রতি মুহূর্তে তার মনে কী ভাবের উদয় হইতেছে ভূপেন স্পষ্ট অনুমান করিয়া যাইতেছিল। আগেও এটা সে খেয়াল করিয়াছে। প্ৰভা কী বলিবে, তাব কথা শুনিয়া প্রভাব মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া জাগিবে, আগে হইতেই সে যেন তা জানিতে পারে। সবদিন নয়, মাঝে মাঝে। যেদিন প্রভাব সঙ্গে কোনো বিশেষ কথা আলোচনা কবিবার থাকে অথবা মেদিন প্রভাকে দেখিবােব জন্য মন অত্যন্ত ব্যাকুল হইযা পড়ে, সেইদিন। হযতো এই সব বিশেষ দিনে তাব মন বুদ্ধি ইন্দ্ৰিয সমস্ত জগতের সঙ্গে সম্পর্ক প্রত্যাহার কবিয়া শুধু প্রভাকে আশ্রয় করে বলিয়া এটা সম্ভব হয়, প্রভার চোখের পাতা কঁপিয়া গেলে, অধরোষ্ঠেব মিলন রেখার তুচ্ছ একটু ব্যতিক্রম ঘটিলে তাও তার চোখ এড়ায় না, সে মানে বুঝিতে পাবে। এমনিভাবে কিছু না জানিয়াও সে জানিতে পারিয়াছিল প্ৰভা তাকে ভালোবাসে। এমনভাবে জানিতে পারিষাছিল যে মাঝে মাঝে তার মনে হইত। পৃথিবীর সমস্ত মানুষও বুঝি জানিতে পাবিয়াছে তাব ভালোবাসাব কথা, এত স্পষ্ট ছিল প্রভাব নিঃশব্দ ভাষাহীন ঘোষণা ! আজ আগাগোড়া ভূপেনের মনে হইতেছিল, প্ৰভা তাকে কী যেন একটা আঘাত দিবাব জন্য প্ৰস্তুত হইয়া আছে। এখন একা বসিয়া এই আশঙ্কটাই তার প্রবল হইয়া উঠিতে থাকে। কোন দিক দিয়া কীভাবে আঘাতটা আসিবে সে বুঝিতে পাবে না, কিন্তু তাকে যে মর্মাহত হইতে হইবে এ বিষয়ে সে নিঃসন্দেহ হইয়া থাকে। অজানা বিপদেবী প্ৰতীক্ষা করব মন লহঁয সে প্রভার ফিবিয়া আসার প্রতীক্ষা করিতে থাকে। প্ৰভা ফিরিয়া আসিয়া বলে, চা আনতে বললাম আব্ব সন্দেশ। বাড়িতে তৈবি।। ভূপেন বলিল, আমিও তাই ভাবছিলাম। সন্দেশেব কথাটা বাদে। প্রভা বলিল, তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে। অামাব। ভূপেন বলিল, আমি তাও ভাবছিলাম প্রভা। বাহিরে শান্তভাব বজায় বাখিযা ভূপেন উদবেলিত হূদয়ে প্রতীক্ষা করে। ছোটাে টিপয়টিতে প্রভ হাত রাখিযাছে, তাব হাতেবা আঙুলগুলি আশ্চর্যরকম কোমল । কে বলিবে হাতটি একজন ডাক্তারের, অতি অনমনীয্য কঠোব প্রকৃতির ডাক্তাবের, যে স্ত্রীলোক হইয়াও স্ত্রীলোক নয। প্রভা চুপ কবিয়া আছে দেখিয়া ভূপেন একটু আশ্চর্য হইয়া গেল। আঘাত দিতে সে তো কখনও ইতস্তত করে না। কী বলছিলে প্ৰভা ? বলছিলাম, আমাদের ওটা ছ-মাস এক বছব পিছিযে দেওয়া যাক। তাড়াতাড়ি করার কী আছে ! তাড়াতাড়ি ! আট বছর অপেক্ষা কবার পরেও প্রভার আজ তাড়াতাড়ি মনে হইতেছে ! বাগ করিবে ভাবিয়াও কিন্তু ভূপেন রাগ করিতে পাবে না। একটু অভিমান পর্যন্ত তার জাগে না। প্রভার কথা শুনিয়া তার অনুভূতির জগতে হঠাৎ এক অদ্ভুত পরির্বতন ঘটিযা যায, কতগুলি অনুভূতি যেন বাধা তারের মতো অতিরিক্ত মোচড়ে টনটন করিতেছিল, হঠাৎ ঢ়িল হইয়া গিয়াছে। কিছুদিন হইতে একটা যে অস্বাভাবিক উত্তেজনা তাকে পীড়ন করিতেছিল, সর্বদা শ্ৰাস্তি আর বিরক্তিবোধ মেজাজ খারাপ করিয়া রাখিয়াছিল, সমস্ত মিলাইয়া গিয়া সে শুধু অনুভব করে অবসন্নতা। বারবার মনে হইতে থাকে, আরও ছ-মাস এক বছর কোনো পবিবর্তন দরকার হইবে না, আরও কিছুকাল প্ৰভাকে আগের মতো কাছে পাওয়া যাইবে। সেও কি বিবাহের দিন পিছইয়া দিতে চাহিয়াছিল ? প্রভা মুখ ফুটিয়া বলিতে পারিয়াছে, সে শুধু ইচ্ছােটা মনের মধ্যে গোপন করিয়া রাখিয়াছিল ? বেশ, তাই হবে। ভূপেন বলে। তুমি এত সহজে রাজি হবে ভাবিনি। রাগ করবে না ?